কাগজের কারিকুরি

কাগজের ফুল। ছবি: কাগজামি
কাগজের ফুল। ছবি: কাগজামি

‘ওরি’ মানে ভাঁজ, ‘গামি’ মানে কাগজ। দুইয়ে মিলে ওরিগামি। তাহলে বাংলায় একে কী বলা যায়? ভাঁজ + কাগজ = ভাঁগজ? অতটা শ্রুতিমধুর হলো না। কাগজের বদলে পাতা বা পত্র ব্যবহার করলে ওরিগামির বাংলা হিসেবে ‘ভাঁজপত্র’ দিব্যি চলে যায়। সে যা হোক, ওরিগামি জাপানি শব্দ। বুঝতেই পারছেন, এক তা কাগজ ভাঁজ করে বিচিত্র সব জিনিস তৈরির এই পদ্ধতি এসেছে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান থেকেই। এর শুরুটা হয়েছিল প্রাচীনকালে। ওরিগামি ধীরে ধীরে জাপানে শিল্পকর্মের স্বীকৃতিই পেয়েছে। এখন এই শিল্পের চর্চা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। সুকুমার রায়ের ‘হ–য–ব–র–ল’ গল্পে রুমাল হয়ে যায় বিড়াল। ওরিগামিতে কাগজ বিড়াল তো হয় বটেই, মহাকাশযানের সোলার প্যানেলও হয়ে ওঠে।

সাধারণত বর্গাকার ও রঙিন কাগজ ব্যবহার করা হয় ওরিগামিতে। কোনো কাটছাঁটের বালাই নেই। কাগজ কাটছাঁট করে কিছু তৈরি করা হলে সেটিকে বলা হয় কিরিগ্যামি। এ–ও জাপানের আবিষ্কার। ওরিগামির সৌন্দর্যই হলো ভাঁজে। কিছু কিছু ভাঁজ আবার এতটাই জটিল যে তার জন্য রীতিমতো সূত্র মুখস্থ রাখতে হয়। সূত্র যা–ই হোক, অন্যভাবে দেখলে ওরিগামি তো একটি ভাষাও। জাপানি এই শিল্পের চর্চা আপনিও করেছেন। ছেলেবেলায় বর্ষাকালে কাগজ দিয়ে নৌকা

বানায়নি, এমন বেরসিক বাঙালি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। কিংবা উড়োজাহাজ বানিয়ে বাল্যপ্রতিভা জাহির না করার মতো শিশু–কিশোরও দুর্লভ। তো ওই নৌকা ও উড়োজাহাজ যখন বানিয়েছেন, তখন আপনিও ‘ওরিগামি ভাষা’য় কথা বলেছেন। এ কারণেই সারা বিশ্বের ওরিগামিপ্রেমীরা মিলে বহু সংঘ–সমিতির গোড়াপত্তন করেছেন। তার মধ্যে ব্রিটিশ ওরিগামি সোসাইটি, ওরিগামি ইউএসএ বেশ বড় সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত। এ ধরনের বহু সংঘ সারা বিশ্বে আয়োজন করছে চমৎকার সব প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী।

ওরিগামির চর্চা স্রেফ আনন্দ লাভে সীমাবদ্ধ নেই। এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা রীতিমতো মাথাও ঘামাচ্ছেন। চিকিৎসাপ্রযুক্তি, গণিত, কাঠামোগত যান্ত্রিকতা কিংবা মহাকাশ প্রকৌশলেও ওরিগামি রাখছে বিশাল ভূমিকা। শুরুতেই মহাকাশযানের সোলার প্যানেলের কথা বলেছি। আক্ষরিক অর্থেই মহাকাশযানের সোলার প্যানেল ওরিগামির সূত্রানুযায়ী ভাঁজ করে দেখিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে সোলার প্যানেল সহজেই বহনযোগ্য হয়ে উঠেছে।

ওরিগামির ইতিহাস

ষষ্ঠ শতকে জাপানে কাগজ নিয়ে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। এর পরপরই ওরিগামির চল শুরু। শুরুতে কেবল ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার হতো। কাগজ তখন মহামূল্যবান। ফলে ওরিগামি সে সময় সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদিত সামগ্রীর মোড়ক হিসেবে চর্চিত এক বিষয়। ১৬৮০ সালে লেখা জাপানি কবি ইহারা সাইকাকুর এক কবিতায় ওরিগামি প্রজাপতির কথা বলা হয়েছে। সামুরাই যোদ্ধারাও শুভেচ্ছা বিনিময়ের অনুষঙ্গ হিসেবে ওরিগামি ব্যবহার করতেন। এ থেকে ধারণা করা হয়, হেইয়ান আমলেও (৭৯৪–১১৮৫) ওরিগামির চর্চা হতো। জাপানে ওরিগামি নিয়ে প্রথম বই শেনবাজুরু অরিকাতা প্রকাশিত হয় ১৭৯৭ সালে। জাপানি সংস্কৃতিতে ওরিগামি নিয়ে বহু গল্পও প্রচলিত আছে। তার মধ্যে আবে নো সেইমেই নামের একজন কাগজের পাখি বানায়। সেই পাখি একসময় প্রাণ পেয়ে উড়াল দেয় আকাশে।

ইউরোপে ওরিগামির নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় ১৪৯৮ সালে। ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়োহানেস দ্য স্যাক্রোবাসকোর লেখা বইয়ে কাগজের নৌকার ছবি ছিল। তারও আগে, ১৪৪০ সালে কাগজ দিয়ে বানানো বাক্সের নমুনাও পেয়েছেন গবেষকেরা। তবে এসব যে জাপান থেকে আমদানি করা নয়, তা–ও কেউ হলফ করে বলতে পারেনি।

আধুনিক কালেবিশ্বদরবারে ওরিগামিকে নতুন রূপে চিনিয়েছেন আকিরা ইয়োশিজাওয়া। তাঁকে বলা হয় ওরিগামির গ্র্যান্ডমাস্টার। ১৯৫৪ সালে লিখেছিলেন আতারাশি ওরিগামি গেইজুতসু (নতুন ওরিগামিশিল্প) নামের বইটি। তারপর লিখেছেন আরও ১৭টি বই। ইয়োশিজাওয়ার বক্তব্য অনুযায়ী ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি মডেল বানিয়েছেন তিনি! ইয়োশিজাওয়া মারা গেছেন ২০০৫ সালে। বুঝতেই পারছেন, জীবনের বাকিটা সময় আরও কতগুলো ওরিগামির মডেল বেরিয়েছে তাঁর মাথা থেকে। এখন ওরিগামি শেখা খুব সহজ। বইপত্র বা ওয়েবসাইটে ওরিগামি বানানোর সচিত্র যে কৌশল আমরা দেখি, সেগুলো হলো ‘ইয়োশিজাওয়া–র​্যান্ডলেট সিস্টেম’। ১৯৬১ সালে আর্ট অব ওরিগামি বইয়ে এ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মার্কিন ওরিগামিস্ট স্যামুয়েল র​্যান্ডলেট। 

এখন তো চিঠিপত্রের চল নেই। প্রেমপত্রও জাদুঘরে তোলার সময় এসেছে। একটু খেয়াল করলে
দেখবেন, আগেকার অনেক প্রেমপত্রেই কঠিন ভাঁজ দেওয়া হতো। ভাঁজ তো নয়, যেন পুরোদস্তুর শক্ত পাসওয়ার্ড! সেই ভাঁজওয়ালা চিঠিগুলোও কিন্তু ওরিগামির উদাহরণ। অনেক
কায়দা–কসরত করে খোলার পর সেসব চিঠি পড়ায় অনেক আনন্দ ছিল নিশ্চয়ই!