উৎসবের আনন্দে প্রদর্শনী

>ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ—ভ্রমণকন্যা। নারীদের ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সংগঠনটি নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়েও কাজ করে। তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ভ্রমণকন্যা আয়োজন করেছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনীর। যে প্রদর্শনীটি তরুণ সদস্যদের কাছে হয়ে উঠেছিল এক উৎসব।
অতিথিদের সঙ্গে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের নতুন কমিটির কয়েকজন সদস্য। ছবি: সংগৃহীত
অতিথিদের সঙ্গে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের নতুন কমিটির কয়েকজন সদস্য। ছবি: সংগৃহীত

লিফটের দরজা খুলতেই উৎসবের আমেজটা আঁচ করা গেল এক লহমায়। যাবেই বা না কেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা প্লাজার দোতলায় গ্যালারিতে ঢোকার আগে যে খোলা জায়গাটুকু, সেখানেই তো উল্লাসে মেতে ছিলেন একদল তরুণ। বিচ্ছিন্ন আলাপচারিতায় মুখর তাঁরা। সেসব আলাপচারিতা থেকে ভেসে আসছিল, ফেসবুকের বাইরে কারও সঙ্গে সেই প্রথম দেখা হওয়ার অনুভূতি, কোনো এক দুর্গম পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আবার ‘এই আমি, আমি...’ বলে দেয়ালভাঙা চিৎকারে দৌড়ে গিয়ে দলবদ্ধ সেলফিতে শামিল হওয়ার উল্লাস। এসব জটলার পাশেই ছিল কাগজের শিল্পকর্ম। ফুল-পাখির সেই দুনিয়ায় দেখা মিলল কয়েকজনকে, যাঁদের অনেকে ছবি তুলছিলেন।

তারই সামনে চিত্রশালা প্লাজার আটপৌরে মিলনায়তন। ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সেখানেই ছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনীর সমাপনী আয়োজন। তবে সেই সমাপন অনেককে বিষাদে ভাসিয়েছে। তাঁদের কাউকে বলতে শোনা গেল, ‘আবারও এক বছরের অপেক্ষা...’। এই অপেক্ষার কথাটিই খোলাসা করলেন ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মানসী সাহা, ‘আমরা এই আয়োজনের জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষা করি। গত ২৭ নভেম্বর ছিল ভ্রমণকন্যার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই দিনটিকে উদ্‌যাপন করার জন্যই আমরা প্রতিবছর আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করি। এখানে সারা দেশের সদস্যরা প্রাণের টানে ছুটে আসেন। আড্ডা হয়, হইহুল্লোড় হয়, বছরের পরিকল্পনা হয়। বলা যায়, এটা আমাদের মিলনমেলা।’

ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ নারীদের ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা সংগঠন। নিজেদের সংগঠনের সদস্যরা ভ্রমণকন্যা হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁদেরই তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করেছিল ভ্রমণবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর। পাঁচ দিনের আয়োজনটি শুরু হয়েছিল ২৭ নভেম্বর। তবে সেই প্রদর্শনীর কাজ শুরু হয়েছিল আরও আগে। অনলাইনে আহ্বান করা হয়েছিল ভ্রমণবিষয়ক লেখা ও ছবির। নারীদের নির্বাচিত ভ্রমণকাহিনি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ভ্রমণকন্যা ম্যাগাজিন। দেশ-বিদেশের আলোকচিত্রী আর ভ্রমণপিপাসু মানুষের পাঠানো ছবি থেকে বিচারকদের রায়ে নির্বাচিত ২০০ ছবি জায়গা পেয়েছিল গ্যালারিতে।

গ্যালারিতে ঘোরার সময় কথা হয় ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের সদস্য মিতালি মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘এই প্রদর্শনী ভ্রমণকন্যার প্রতিটি সদস্যের কাছে এক উৎসবের নাম। ঈদ বা পূজার মতোই সারা বছর অপেক্ষা করি আমরা। সবার সঙ্গে দেখা হওয়ার এই একটাই সুযোগ।’

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ছবিগুলো মুগ্ধ করেছিল দর্শনার্থীদের
প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ছবিগুলো মুগ্ধ করেছিল দর্শনার্থীদের

তাঁর উচ্ছ্বসিত কথায় জানা গেল, প্রদর্শনী সফল করতে দুই–তিন মাস ধরে স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করেন। সাংস্কৃতিক পর্বের জন্যও চলে নিয়মিত রিহার্সাল। শেষ বেলায় ম্যাগাজিনের জন্য নির্ঘুম কাজ করেন প্রেসে, কারও কারও দৌড়ঝাঁপ চলে ছবি বাঁধাইয়ের কাজে, অতিথি আমন্ত্রণ ও অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায়। এসবই করেন সংগঠনের নারী সদস্যরা। ‘তাই এই প্রদর্শনী আমাদের কাছে ভালোবাসার মহোৎসব।’ বলেন পাশে দাঁড়ানো হালিমাতুস সাদিয়া নামের আরেক ভ্রমণকন্যা।

ততক্ষণে সমাপনী আয়োজন শুরু হয়েছে। গ্যালারিও ক্ষণিকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো। দর্শনার্থীদের সঙ্গে মিলনায়তনে প্রবেশ করতেই কানে বাজল পর্দায় ভেসে ওঠা এক কিশোরীর কণ্ঠ, ‘আমার অনেক ভালো লাগল, অনেক কিছু জানতে পারলাম, অনেক কিছু শিখলাম। তোমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো, মেডিকেলে পড়ো, তোমাদের সঙ্গে ছবি তুললাম। তাহলে আমিও তো ঢাকা মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারি।’

নারীর চোখে বাংলাদেশ-দ্য স্কুটি গার্ল নামের তথ্যচিত্রটি যখন পর্দায় প্রাণ পেয়েছে, নিজেদের ছবি আর ভিডিওতে কথা শুনে ভ্রমণকন্যারা সোল্লাসে চিৎকার করে উঠছিল। তথ্যচিত্রের এমনই একটি অংশে কথাগুলো বলে যায় জামালপুরের সরিষাবাড়ীর স্কুলপড়ুয়া মেয়েটি। নিপাট হাসিতে থরে থরে সাজিয়ে সে কথাগুলো বলে গেল। সেই হাসিমাখা কথায় মিশে থাকল একরাশ স্বপ্ন।

ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের আরেক প্রতিষ্ঠাতা সাকিয়া হক বলেন, ‘মেয়েদের এমন স্বপ্ন দেখানোর কাজই করছে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ। আমরা এখন ৪৫ হাজার সদস্যের সংগঠন। ৭০টি ভ্রমণ আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ নারী। তাঁদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও অনেক নারী বেরিয়ে পড়েছেন ঘুরতে।’

মিলনায়তন তখন পূর্ণ হয়েছিল অতিথি, শুভাকাঙ্ক্ষী আর দর্শনার্থীদের উপস্থিতিতে। তাঁদের সামনেই নিজেদের কাজের বিস্তারিত তুলে ধরে কথাগুলো বলেন সাকিয়া হক। তাঁর কথায় জানা হয় ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ নামের উদ্যোগটি সম্পর্কে। যে উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁরা স্কুটি চালিয়ে দেশ দেখার পাশাপাশি প্রায় ২৩ হাজার স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে স্বাস্থ্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন। যে কাজটি ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে চালিয়ে যেতে যান।

সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি বললেন, প্রতিনিয়ত ‘না না’ শুনে বড় হওয়া মেয়েগুলোর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় নিজের চারপাশে সমাজ ও পরিবার যে শক্তপোক্ত দেয়াল তৈরি করে দেয়, সেটা ভাঙার মাধ্যমে। সেই দেয়াল ভাঙার কাজটি করছে ভ্রমণকন্যারা।

বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন কার্টুনিস্ট ও উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীব। তিনিও বললেন প্রেরণার কথা, ‘ভ্রমণকন্যারা শুধু ভ্রমণকন্যা নন, তাঁরা সাহসী কন্যা।’

অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হলো উপদেষ্টা পরিষদ আর নতুন কমিটি। শেষবেলায় ছিল ভ্রমণকন্যাদেরই উপস্থাপনায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। নির্মল আনন্দ-উৎসবের বাজনায় সে পরিবেশনায়ও হৃদয় ছুঁয়ে গেল। উৎসবের যেন ষোলোকলা পূর্ণ হলো। আর এমন উৎসবের আবহেই তো মেয়েদের এই সংগঠনটি কাজ করে চলেছে, স্বপ্ন দেখাচ্ছে প্রথাগত শৃঙ্খল ভাঙার।