এক হাতে বইঠা আরেক হাতে ক্যামেরা

তখন শীতের শুরু। সকাল সকাল রাজশাহীর পদ্মার চর আমাদের গন্তব্য। দল বেঁধে পাখির ছবি তুলতে যাব। এই দলে আমি নতুন। পাখি দেখতে যাওয়ার আয়োজন সম্পন্ন। শুকনো খাবার, ক্যামেরা, লেন্স, লাইফ জ্যাকেটসহ সবকিছু নেওয়া হয়েছে। চরের কাছাকাছি যেতে না যেতেই নৌকার ওপর থেকে উড়ন্ত দুটি পাখি দেখিয়ে নৌকার মাঝি অনিক ইংরেজি নাম ধরে বলে উঠল, ‘রেড ন্যাকেড স্টিন্ট বার্ড এটি’। এত শুদ্ধ উচ্চারণ আর ইংরেজি নাম শুনে আমি অবাক হলেও দলের অন্যরা এটি স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। কেননা অনিককে তাঁরা অনেক বছর ধরে চেনেন। এই পাখির বাংলা নাম জানতে চাইলে অনিক জানাল, লাল ঘাড় চাপাখি। এরপর আরও কিছু পাখি দেখে তার ইংরেজি ও বাংলা নাম বলতে থাকল অনিক। পাখির ছবি তুলতে নৌকা থেকে নামার সময় দেখি অনিকের হাতেও বড় লেন্স আর ক্যামেরা। এটি তার নিজের। নৌকার চালক এটা অনিকের একটা পরিচয়। আরেক পরিচয় সে একজন আলোকচিত্রী।

একজন আলোকচিত্রীকে নিয়ে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনিক। ছবি: মেজবাউল হাসান
একজন আলোকচিত্রীকে নিয়ে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনিক। ছবি: মেজবাউল হাসান

গল্পের শুরু

অনিকের গল্পটা অন্য রকম। বাবা আসাদুজ্জামান ছোট ব্যবসা করতেন। ব্যবসা ভালো হলো না তাঁর। বেশ কিছু টাকা খুইয়ে নিঃস্ব প্রায়। ধারকর্জ করে নৌকা কিনলেন একটা। সেই নৌকা ভাসালেন রাজশাহীর পদ্মা নদীতে। দিনের কিছু সময় মাছ ধরেন আর মানুষজনকে পদ্মার এপার ওপার পারাপার করে দেন। বড় ছেলে নাসিমুজ্জামান অনিক তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। ছেলে বাবার সঙ্গে সহকারী হিসেবে যেতে থাকল নদীতে। পড়াশোনা বন্ধ হলো।

অনিকের তোলা জোসনা রাতে লক্ষ্মীপ্যঁাচার ছবি (ডাবল এক্সপোজার)
অনিকের তোলা জোসনা রাতে লক্ষ্মীপ্যঁাচার ছবি (ডাবল এক্সপোজার)

বছর তিন বাদে একটু সচ্ছলতা এল আসাদুজ্জামানের পরিবারে। অনিক আবার স্কুলে যেতে শুরু করল। কিন্তু পদ্মার মায়া সে ভুলতে পারে না। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাজে সহায়তা করতে লাগল। অবসরে পরিবার নিয়ে অনেকে রাজশাহীতে পদ্মার চরে ঘুরতে যান। তাঁদের নৌকায় করে ঘুরিয়ে আনত অনিক। অনেকটা ট্যুরিস্ট গাইডের মতো কাজ করত সে।

২০১৫ সালে অনিকের নৌকায় প্রথমবারের মতো ওঠেন একদল আলোকচিত্রী। তাঁরা এসেছিলেন পাখির ছবি তুলতে। প্রতিবছরই আসতে শুরু করল দলটি। আলোকচিত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে অনিকও যেত, ছবি তোলা দেখত। একাগ্রচিত্তে দীর্ঘ সময় ধরে নানা রঙের নানা প্রজাতির পাখি দেখা, ছবি তোলা মন কাড়ে অনিকের। দুই–একটা নামও শুনতে শুনতে আয়ত্তে আসে অনিকের। নোয়াখালীর আলোকচিত্রী শাহাদাৎ রাজু একদিন তাকে একটি বাইনোকুলার উপহার দেন। অনিক বলে, ‘ওই দিন যখন রাজু ভাই বাইনোকুলার দিলেন, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। পাখির ছবি তোলার জন্য যাঁরা যেতেন, তাঁদের সঙ্গে আমি গিয়ে গিয়ে পাখি দেখতাম।’ ২০১৫ সালে রাজশাহীর সিটি কারিগরি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে অনিক। এরপর ভর্তি হলো রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে।

স্বপ্নের পথে অনিক

রাজশাহীতে এসে পাখির ছবি যাঁরা তোলেন, তাঁদের সবাই অনিককে ফোন করলে সে নৌকা তৈরি করে রাখবে। এভাবেই আলোকচিত্রীদের একাধিক দলের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে অনিকের। একদিন অনিককে অবাক করে দিয়ে বার্ড বাংলাদেশ সংগঠনের সদস্য সায়েম এস চৌধুরী তাকে প্যানাসনিকের একটি ক্যামেরা উপহার দেন। ক্যামেরা পেয়ে অনিকের খুশি আর কে দেখে! ছবি তুলতে শুরু করল। আস্তে আস্তে পাখি চিনতে শুরু করল। বগুড়ার আলোকচিত্রী আদনান আজাদ তাকে উপহার দিলেন পাখির পরিচিতিমূলক একটি বই। বাংলা ও ইংরেজি নামে চিনতে শুরু করল পাখি। কেটে গেল আরও একটি বছর।

জালে আটকা পড়া বক ছেড়ে দিচ্ছে অনিক। তখন ছবিটি তোলেন হাসনাত রনি
জালে আটকা পড়া বক ছেড়ে দিচ্ছে অনিক। তখন ছবিটি তোলেন হাসনাত রনি

একদিন রাজশাহীতে পাখি দেখতে এলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান। তিনি অনিকের পাখিপ্রেমের কথা জানতে পেরে বেজায় খুশি হলেন আর উপহার দিলেন তাঁর লেখা বই। বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী রেজা খানও রাজশাহী এসে অনিকের নৌকায় করে পাখির ছবি তোলেন। তিনিও অনিকের পাখিপ্রীতি দেখে মুগ্ধ হন। বিদেশি পাখির বই উপহার দেন তাকে।

পাখির প্রতি ভালোবাসা যখন অনিকের ধ্যান-জ্ঞান, তখন ঢাকার উত্তরার আলোকচিত্রী শওকত শুভ রাজশাহী গিয়ে অনিকের নৌকা ভাড়া নিলেন পাখির ছবি তুলতে। আর ঢাকা ফেরার সময় অনিকের হাতে তুলে দিলেন ক্যামেরা। শাহাদত আমিন খান নামের আরেক আলোকচিত্রী অনিককে দিলেন ১৫০-৬০০ মিলিমিটার জুম লেন্স। ক্যামেরার বডি দেন এমদাদুল ইসলাম। ক্যামেরা আর লেন্স পেয়ে অনিক যেন পাখির মতোই উড়তে লাগল! পড়ালেখা, সংসারে সহযোগিতার পাশাপাশি প্রতিদিনই নিত্যনতুন পাখির খোঁজ চলতে থাকল।

অনিকের তোলা পাখির ছবিগুলো এমন। ঘড়ির কাঁটার দিকে—পাকড়া উল্টো ঠোঁটি, তিলা-লালপা ও পালাসি গাঙচিল
অনিকের তোলা পাখির ছবিগুলো এমন। ঘড়ির কাঁটার দিকে—পাকড়া উল্টো ঠোঁটি, তিলা-লালপা ও পালাসি গাঙচিল

অনিকের সম্পর্কে রেজা খান বলেন, ‘তাকে তো বই উপহার দিয়েছিলাম। সে দারুণ পাখিপ্রেমী, আর ভালো ছবি তোলে। নতুন নতুন পাখি দেখলে যোগাযোগ করে তার পরিচয় জানতে চায়। এ ছাড়া পাখি মারার বিরুদ্ধে সে সচেতনতামূলক কাজ করছে।’

রোমাঞ্চের হাতছানি

পাখির ছবি তুলতে তুলতে গত বছর অনিক দেখা পায় ইউরোপীয় চামুচঠোঁটি পাখি। পৃথিবীতে মহাবিপন্ন এই পাখি দেখে অন্য আলোকচিত্রীদের খবর দেয় সে। রাজশাহীর চরে এক দিনেই এই পাখি ১৬টা দেখা যায়। অনেক দিন পর এই পাখি বাংলাদেশে দেখতে পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে পক্ষীবিশারদদের মধ্যে।

বাংলাদেশে যেসব দুর্লভ পাখি আছে তার মধ্যে আছে মানিকজোড় পাখি। দেশে পাঁচ ধরনের মানিকজোড় দেখা পাওয়া যায়। এর সব কটির ছবি তুলেছে অনিক। এর বাইরে ফুলই হাঁস, তিলিহাঁস, পাতি চখাচখি, খয়রা চখাচখি, লালঝুঁটি ভুতিহাঁস, মরচে ভুতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, উত্তরের বনতেহাঁসসহ প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছে। পাখি দেখলেই বলে দিতে পারে কোন প্রজাতির পাখি এটি। তার তোলা ছবি রাজশাহীর একটি প্রদর্শনীতে ও ঢাকায় ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ পেন্সিলের ছবি প্রদর্শনীতে স্থান পায়। রাজশাহীর বাইরে বাইক্কা বিল, সাতছড়ির বন ও লাউয়াছড়ায় পাখির ছবি তুলতে গেছে অনিক।

অনিকের শখ ছবি তোলা

অনিকের পাখির ছবি দেখতে চাইলে নিজের ল্যাপটপে ফেসবুকে নিয়ে যায় সে। তাকে এই ল্যাপটপটি উপহার দিয়েছিলেন আলোকচিত্রী শওকত শুভ। অবাক হতে হয় কত কত পাখির বিচিত্র ছবি তুলেছে সে। সঙ্গে সঙ্গে নামও দিয়ে দিয়েছে। রংবেরঙের পাখির ছবি দেখাতে দেখাতে বলে, ‘আমরা ছবি তুলি কিন্তু পাখিদের বিরক্ত করি না। ছবি তুলে আবার চলে আসি।’ অনিক যেসব পাখির ছবি তুলেছে তার মধ্যে অন্যতম নদীয়া-পাকড়া, উল্টোঠোঁটি, পানচিল, ইউরেশিয়ান গুলিন্দা, তিলা-লালপা, পালাসি গাঙচিল, দেশি গাঙচোষা, নানা রঙের মানিকজোড়সহ বিভিন্ন ধরনের বক গোত্রের পাখি। রাতে জোছনার আলোতে লক্ষ্মীপ্যাঁচার ছবি, পেছনে চাঁদের আলোর দারুণ সব ছবিও আছে তার ক্যামেরায়।

.
.

অনিক বলে, পাখির ছবি তুলতে যাওয়ার সময় আলোকচিত্রীদের কাছে ক্যামেরা ক্লিক করা শিখেছে। তবে ছবি তোলার সবচেয়ে ভলো দীক্ষা দিয়েছেন রাজশাহীর আলোকচিত্রী হিমেল নবী। হিমেল শিখিয়েছেন লাইট আর ক্যামেরার সমন্বয়।

পাখিদের বাঁচাতে

কেবল পাখির ছবি তুলেই থেমে যায়নি অনিক। সব আলোকচিত্রীকে একসঙ্গে করে তাঁদের মাধ্যমে পাখি শিকার বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে। এর ফলও পাওয়া গেছে। আগে যে মাঝি আর জেলেরা রাজশাহীতে বিষ টোপ দিয়ে পাখি শিকার করত, তারা এখন আর সেটি করে না। কেউ করলে তাকে বাধা দেয়। এ ছাড়া এই মাঝিরা কোনো পাখি শিকারিকে নৌকায় তোলে না। কেউ পাখি শিকার করে আনলে সেই পাখি ছেড়ে দেওয়ার কাজও করে অনিক। এভাবে কয়েকজন শিকারিকে প্রশাসনের হাতে তুলে
দিয়েছে সে।

অনিককে ২০০৯ সাল থেকে চেনেন ব্যাংকার হাসনাত রনি। বললেন, অনিক যে পাখির সুন্দর ছবি তোলে তা–ই নয়, পাখি শিকারের বিরুদ্ধে সচেতনতার কারণে এখন পদ্মায় পাখি শিকার কমে এসেছে। কীভাবে পাখি দেখতে হয়, নৌকা নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে হয় তা অনিক খুব ভালো জানে।

অনিকের ব্যস্ততা বেড়েছে

এই শীত মৌসুমে অনিকের ব্যস্ততা বেড়েছে বহুগুণ। প্রায় প্রতিদিনই আলোকচিত্রীদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে। তাঁদের ঘুরে দেখাচ্ছে রাজশাহীর চর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর, রাজশাহীর মোহনপুর, তানোর, নাটোরসহ বিভিন্ন জায়গা। এর বিনিময়ে সে যে টাকা পায় তা নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারেও সহায়তা করে। অনিক বলছিল, ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে ঘুরলে ছবি তোলাও হয় আবার পরিবারের জন্যও কিছু আয়ও হয়।

কতদূর যেতে চায় অনিক? অনিক মৃদু হাসে। বলে, নিজের জীবন বনবাদাড়ে কাটিয়ে দিতে চাই। ছবি তুলে এভাবেই সে থেকে যেতে চায় বনের পশুপাখির সঙ্গে। আর মানুষকে সচেতন করার জন্যও কাজ করার ইচ্ছা তার।