জলহস্তীর মনেও দরদ আছে

নূর আলমের হাতের খাবার ছাড়া যেন জাতীয় চিড়িয়াখানার জলহস্তীদের পেটই ভরে না! ছবি: আশরাফুল আলম
নূর আলমের হাতের খাবার ছাড়া যেন জাতীয় চিড়িয়াখানার জলহস্তীদের পেটই ভরে না! ছবি: আশরাফুল আলম
>ঢাকার মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানার বন্য প্রাণী তত্ত্বাবধায়ক নূর আলম। ৩৫ বছর ধরে তিনি জলহস্তীর পরিচর্যা করছেন। তাঁর কথা শোনে সেখানকার জলহস্তীরা। তাদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্য। নূর আলমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কমল জোহা খান

জাতীয় চিড়িয়াখানায় কবে এলেন?

নূর আলম: আমার বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দারিয়াল গ্রামে। পড়াশোনা বেশি করতে পারিনি। কাজের খোঁজে ঢাকায় এসেছিলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমার চাচাতো ভাই মালির কাজ করতেন। তিনি ১৯৮৩ সালে খবর পান যে চিড়িয়াখানায় বন্য প্রাণীর তত্ত্বাবধায়ক পদে বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ খবর পাওয়ার পর আমাকে না জানিয়ে একটা দরখাস্ত চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বরাবর জমা দেন। ওই বছর জুন মাসে ২২৫ টাকা বেতনে আমার চাকরি হয়। সেটি ছিল স্থায়ী চাকরি। 

তখন থেকেই জলহস্তীর দেখভাল করেন?

নূর আলম: প্রথম দিকে আমার দায়িত্ব পড়ে শিম্পাঞ্জির ঘরে। তখন চারটি শিম্পাঞ্জি ছিল চিড়িয়াখানায়। প্রথম দিকে ভয় লাগত। কীভাবে খাওয়াব, কীভাবে ওদের দেখাশোনা করব। এক বছর পর আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। কারণ, ১৯৮৪ সালে আফ্রিকা থেকে আনা হলো একটি জলহস্তী। ওর বয়স তিন বছরের মতো হবে। আমি নাম দিলাম টিটু। 

জলহস্তী তো অনেক বড় প্রাণী, ভয় লাগল না? 

নূর আলম: ভয় মানে কি! সেই রকম ভয়। টিটু যখন চিড়িয়াখানায় এল, কয়েক দিন তো পানিতে নামেনি। চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে থাকত। এত বড় জন্তু, দেখেও ভয় লাগল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন আমি আর লাল মিয়া নামের এক সুপারভাইজার টিটুর গায়ে পানি মারি। তাতেও নড়ে না। এরপর ১৫ জন মিলে টিটুকে পানিতে নামালাম।

জলহস্তী টিটুর সম্পর্কে কিছু বলুন...

নূর আলম: ১৯৮৮ সালে টিটুর আচরণ ভীষণ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। সেপ্টেম্বর মাসে বন্যার সময় টিটু চিড়িয়াখানার বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে যায়। কখনো থাকত পাশের তুরাগ নদে। আবার চলে যেত বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এভাবে ১৬ দিন টিটু বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। রাতে খাবার খেতে চিড়িয়াখানায় আসত। একদিন রাতে আমরা বুদ্ধি করে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিই। এরপর ওর মাথার দিকে আলো ফেলি। আলো ফেললে টিটু ডুব দেয়। তখন বড় জাল ফেলে আস্তে আস্তে টিটুকে খাঁচায় নিয়ে আসা হয়। ১৯৮৯ সালে টিটুর সঙ্গী আসে। ওর নাম দিই ডায়না। এর তিন বছর পর ১৯৯২ সালে ডায়না আর টিটুর সংসারে জন্ম নেয় ওদের বাচ্চা। নাম দেওয়া হলো জলসুন্দরী। এভাবে ১৮টি বাচ্চার জন্ম আমার হাত ধরেই হয়েছে। 

নূর আলম
নূর আলম

জলহস্তীর আচরণ বুঝতে পারেন কীভাবে? 
নূর আলম: আপনারা দেখলে মনে করবেন সব জলহস্তীর হয়তো চেহারা এক রকম। আসলে তা নয়। প্রত্যেকের চেহারায় আলাদা ধরন রয়েছে। এটি আমি দেখতে দেখতে এখন বুঝতে পারি। এক দেখাতে বলতে পারি, কোনটি টিটু আর কোনটি জলসুন্দরী বা ডায়না। ওদের স্বভাবে পার্থক্য আছে। যেমন টিটুর কথাই বলি। জলহস্তীর সংসারে যখন সদস্য বাড়ল, তখন থেকে টিটুর মধ্যে একটা নেতা নেতা ভাব দেখা দিল। ও মনে করত, জলহস্তীদের রাজা। টিটুর কথা না শুনলেই অন্যদের মারধর করত। আবার টিটু-ডায়নার বড় মেয়ে জলসুন্দরীর মধ্যে একটু বেপরোয়া ভাব এখনো আছে। কারণ, জলসুন্দরী সবার বড় মেয়ে। তবে ওরা সবাই আমার কথা শোনে। আমি ডাকলে কাছে আসে, খাবার খায়। বসতে বললে বসে পড়ে। ঘরে যেতে বললে ঘরে চলে যায়। অবুঝ প্রাণী হলেও আমার প্রতি ওদের মনে দরদও আছে। অনেক আগে যখন ডায়না আসে, তখন বিপদে পড়েছিলাম। ডায়না আমার দিকে তেড়ে এসেছিল। কিন্তু টিটু মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডায়নাকে বাধা দেয়। না হলে ডায়না হয়তো আমাকে মেরেই ফেলত।

নিজের সংসারজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন 

নূর আলম: ১৯৮৮ সালে হেলেনা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক দিন পরই টিটু খাঁচা থেকে বের হয়ে যায়। তখন দুই মাস নতুন বউয়ের সঙ্গে দেখাই করতে পারিনি। আমার স্ত্রী তো মাঝেমধ্যেই বলে, ‘তুমি জলহস্তীর পাশে আরেকটা খাঁচা বানায়া ওখানেই থাকো।’ আমাদের তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে রাহাত হোসেন এমএ পাস করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। মেজ ছেলে নাজমুল আলম আহ্​ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করছে। ছোট ছেলে রনি আহামেদ সাভার কলেজে স্নাতক পড়ছে। মেয়ে মেহেরিন আক্তার আশুলিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। নিজের সন্তানেরা যেমন আমার আপন, আবার এই জলহস্তীরাও আমার আপন।