স্বপ্নভঙ্গের কথা

বাবা হতে যাচ্ছি কথাটা যখন প্রথম শুনলাম, আনন্দে নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। অনাগত সন্তান এবং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সহস্র স্বপ্ন, ইচ্ছে, পরিকল্পনা একসঙ্গে উঁকি দিতে লাগল। 

 ২০ এপ্রিল, অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এল। আমাদের জগৎকে আলোকিত করে জন্ম নিল প্রথম পুত্রসন্তান তাওহীদ। এ যেন এক নতুন আবিষ্কার। এক নতুন অনুভূতি। তাওহীদের জন্মের পরপরই আরেকটি কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ধরা দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এক নতুন ক্যারিয়ার পেলাম। সীমাহীন সুখের মধ্য দিয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। এভাবে মাস, বছর কেটে গেল। কাটল আরও একটি বছর। এরই মধ্যে হঠাৎ মনের ভেতরে বাসা বাঁধল এক দুশ্চিন্তা। তাওহীদের মানসিক বিকাশ এবং অতি চঞ্চলতা আমাদের ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ডাক্তার, কবিরাজের কাছে শুরু হলো ছুটোছুটি। অবশেষে একদিন চিহ্নিত হলো আমাদের অতি আদরের সন্তান অটিজমে আক্রান্ত। জীবনে যুক্ত হলো স্বপ্ন ভঙ্গের এক নতুন অধ্যায়। আজ পর্যন্ত অটিজমের কারণ যেমন নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।

তবে এমন সন্তানের গর্বিত পিতা হিসেবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এমন সন্তানের পিতা–মাতা হওয়ার জন্য কেউ প্রস্তুত থাকেন না। সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিগগিরই জানতে না পারলেও কিছুদিন পর আকস্মিকভাবে পিতা–মাতাকে সেই চরম সত্য কথাটি শুনতে হয় যে তাদের সন্তানটি অটিস্টিক! সব স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিভে যায়। পরিবারটি চিহ্নিত হয় একটি যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে, সেখানে বিরতিহীনভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে সন্তানের অস্তিত্বের জন্য। একজন মাকে তাঁর ক্যারিয়ার কিংবা স্বপ্নের দরজায় তালা লাগিয়ে তাঁর বিশেষ সন্তানটির লালন-পালনের জন্য নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয় সেই যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেই। যুদ্ধক্ষেত্র আর কর্মক্ষেত্র—এই দুই ক্ষেত্রকেই সমানভাবে সামাল দিয়ে চলতে হয় পিতাকেও। কষ্ট, হতাশা, দ্বিধা, অসহায়ত্বের কালো মেঘ আচ্ছন্ন করে রাখে গোটা পরিবারটিকে। এ এক অন্য রকম চ্যালেঞ্জ!

আমাদের তাওহীদ কোনো দিন পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না, তা আমরা ইতিমধ্যে খুব ভালোভাবেই জেনে গেছি। তাই বড় হয়ে সে কী হবে, তা স্বাভাবিক সন্তানের পিতা–মাতার মতো আমরা আর কোনো স্বপ্নও দেখি না। যদিও ওর সমবয়সী শিশুদের দেখলে আচমকা এক কষ্ট আর হতাশায় নিমজ্জিত হই। আমাদের জীবনটা যেন জীবনব্যাপী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যে যুদ্ধ এই জনমে শেষ হওয়ার নয়, যে যুদ্ধের সমাপ্তি বা যুদ্ধ–পরবর্তী স্বাধীনতা আমরা ভুলেও কামনা করতে পারি না। ওর জন্য আমাদের সব শ্রম, সময়, ধৈর্য, অর্থ, চ্যালেঞ্জ, সর্বোপরি আমাদের যুদ্ধটা একমুখী, যার রিটার্ন বা প্রতিদান আমরা হয়তো এই জনমে পাব না বা আশাও করি না। এরপরও আমরা গর্বিত। 

তবে আমরা যতই গর্বিত হই না কেন, আমাদের সন্তান ও পরিবার অন্যদের কাছে যে একটু অন্যভাবে চিহ্নিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই! যাদের খুব কাছের বা পরম আত্মীয় হিসেবে জানি, তারাও আমাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে চান না। আর তা অনিবার্য কারণবশত গ্রহণ করলেও তৃপ্ত হতে পারেন না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা যেন কোনো এক অজানা দ্বীপের বাসিন্দা।

একটি স্বপ্ন হয়তো ভেঙেছে, কিন্তু অসংখ্য নতুন স্বপ্ন এসে ভিড় জমায় মনে। নিজের সন্তানকে নিয়েই শুধু আর স্বপ্ন দেখি না; তার মতো সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-ব্যক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েই স্বপ্ন দেখি। পিতা-মাতার অবর্তমানে আমাদের এমন সন্তানদের কী হবে? সচেতনতা বেড়েছে কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা কি বেড়েছে? এক অনিশ্চিত অবস্থায় বসবাস করে স্বপ্ন বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা কতটুকু? সুতরাং অসংখ্য স্বপ্নের ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে বর্তমানে শুধু একটিই স্বপ্ন দেখি, তা হলো আমার সন্তানের মতো সব সন্তানের গ্রহণযোগ্যতা। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সাধারণ সুস্থ মানুষের মতো তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত হবে। সচেতনতার পাশাপাশি গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টিতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। অন্তত জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ভাবতে পারি যে আমার সন্তানটিকে নিরাপদে রেখে গেলাম—কারণ, সন্তান আমার, রাষ্ট্র সবার। 

মো. আখতার হোসেন
শিক্ষক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।