দস্যুতা ছেড়ে অন্য জীবনে

>
আনারুল ইসলাম
আনারুল ইসলাম
সুন্দরবনের বনজীবীদের কাছে বাঘের মতোই আতঙ্কের আরেক নাম বনদস্যু। আনারুল বাহিনী ছিল এমনই একটি দস্যুদল। এই দলের সরদার ছিলেন আনারুল ইসলাম। দস্যুজীবন ছেড়ে দলেবলে ফিরে এসেছেন স্বাভাবিক জীবনে।

খুলনার কয়রা উপজেলা সদর থেকে মঠবাড়িয়া গ্রামের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। আগেই কথা হয়েছিল, তাই গ্রামটির সুতি বাজারে গিয়েই দেখা মিলল আনারুল ইসলামের। ছোট বাজারটিকে সুন্দরবনের থেকে আলাদা করেছে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদী। সে বনেরই ত্রাস ছিলেন আনারুল ইসলাম আর তাঁর দলের সদস্যরা। তবে ডাকু সরদার চিন্তা করলেই যেমন হোমরাচোমরা মানুষের অবয়ব ভেসে ওঠে, তিনি ঠিক যেন তার উল্টো। ছোটখাটো গড়নের আনারুল তাঁর সঙ্গের মানুষটার পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘ও মো. মোস্তফা। আমার দলেই কাজ করত। মাছের খামারটাও একসঙ্গে দিয়েছি।’ 

হাতের ইশারায় বোঝালেন কাছেপিঠেই তাঁদের সেই মাছের খামার। বাহনটি স্থানীয় ফরেস্ট স্টেশনের কাছে রেখে পথ ধরি খামারে যাওয়ার। চলতি পথেই কথা এগোই। আনারুল ইসলাম জানালেন, তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসারে আছে তিন ছেলে। বড় ছেলেটিকে পাঠিয়েছেন ইটভাটায় শ্রমিকের কাজে। বাকি দুজন ছোট। স্কুলে যায় তারা। 

মেঠোপথ ধরে কিছুটা এগিয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। গত বছরের প্রথম দিকে পাঁচ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে মাছের খামার করেছেন। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে
আসার অঙ্গীকার করে সরদার আনারুল ইসলাম দলের ১১ জন সদস্যকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। দস্যুতা ছাড়ায় সরকার ও র​্যাবের পক্ষ থেকে অর্থসহায়তা দেওয়া হয়। সেই টাকায় শুরু করেছেন এই মাছের খামার। শীতের সময় মাছে লাভ হয় কম, তাই এই সময় কাঁকড়ার ব্যবসা করছেন। খামারের একদিকে ছোট একটি ঘরও আছে। রাতে এই ঘরটিতেই দুজন পালাক্রমে পাহারা দেন। সেখানে বসেই শুনি আনারুলের দস্যুজীবনের কথা। 

মামলার ভয়ে বনে
২০০১ সালের কথা। প্রতিপক্ষের দেওয়া মামলা থেকে বাঁচতে সুন্দরবনে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়েন আনারুল। মোজাম বাহিনী তখন সুন্দরবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী দস্যু বাহিনী। তিনটি বড় বড় ট্রলারে অন্তত ৫০ জনের সেই দস্যু বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন আনারুল। সরদার মোজাম পুলিশের হাতে ধরা পড়লে দল ভেঙে যায়। এরপর তিনি ছোটা জাকির বাহিনীর সঙ্গে চলে আসেন সুন্দরবনের আরেক এলাকায়। তত দিনে দস্যু হিসেবে আনারুলের নাম ছড়িয়ে গেছে এলাকায়। বাড়ি ফেরার উপায় ছিল না। এরপর একে একে নোয়াব বাহিনী, মান্নান বাহিনীসহ কয়েকটি দস্যু বাহিনীর সদস্য হয়ে কাজ করেন। সর্বশেষ বিভিন্ন বাহিনী থেকে দলছুট ১৯ জন সদস্যকে নিয়ে নিজের নামেই গড়ে তুলেছিলেন আনারুল বাহিনী। 

 অর্থ এল, শান্তি এল না
তাঁর বাহিনীও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করাসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ল। তবে অর্থকড়ি এলেও মনে ছিল না শান্তি। যেমনটি আনারুল বলছিলেন, ‘অসৎ পথে এ আয়ে সংসারে শান্তি ছিল না। সমাজের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতাম না। ঘৃণা আর আড় চোখে দেখত সবাই। মা, ছোট ভাইবোন ও স্ত্রী—কারও কাছে মুখ দেখাতে পারতাম না। কেউ মিশত না।’ 

এরই মধ্যে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান। র​্যাব-পুলিশের অভিযানের ভয়ে বনের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত ভয় আর উৎকণ্ঠায় কাটে তাঁদের। দস্যু সরদার আনারুল জানালেন, ‘সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল গণ্ডি। তাই ভেবেছিলাম, এ অপরাধের জগৎ ছেড়ে ভালো হয়ে যাব। কিন্তু সেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না।’

অবশেষে আত্মসমর্পণ
অবশেষে সেই সুযোগ পেলেন ২০১৭ সালে, আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। আনারুল ইসলাম জানালেন, তাঁর বাহিনীর কয়েকজন আত্মসমর্পণে রাজি ছিলেন না। দল ছেড়ে পালিয়েও গেছেন কয়েকজন। এরপর পূর্বনির্ধারিত সময়ে সুন্দরবনের ভেতর থেকে ১১ জন সদস্য আর ১৯টি অস্ত্রসহ তাঁরা র​্যাবের হেফাজতে যান। র​্যাবের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণের পর জেলখানায়। এরপর জামিন নিয়ে এলাকায় ফিরে আসা। ফিরেই শুরু করেন মাছ চাষ। 

আনারুলের বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছিল কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রবিউল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আনারুল ও তাঁর দলের সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায় এলাকায় স্বস্তি ফিরেছে। পরবর্তী সময়ে তাঁরা যেন কোনো অন্যায় কাজে না জড়ান, সে জন্য তাঁদের খোঁজখবর রাখছে কয়রা থানা-পুলিশ। তাঁদের নামে থাকা মামলার বিষয়টিও সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।