নাইক্ষ্যংছড়িতে বছরের প্রথম সূর্য

>
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁরা হাজির হয়েছিলেন সূর্য উৎসবে। ছবি: মশহুরুল আমিন
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁরা হাজির হয়েছিলেন সূর্য উৎসবে। ছবি: মশহুরুল আমিন
সূর্য উৎসব জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মিত আয়োজন। দেশের কোনো স্থানে দলবেঁধে গিয়ে নতুন বছরের প্রথম সূর্যকে বরণ করে নেয় সংগঠনটি। এ আয়োজনের নাম সূর্য উৎসব। এবার এটি হয়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে।

ফেসবুকেই জেনেছিলাম এবার বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বর্ষবরণ হবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে। পাহাড়ি এলাকার কথা অনেকের কাছেই শোনা। সুন্দর, সুন্দর, সুন্দর—যার কাছেই জানতে চেয়েছি, প্রত্যেকেই বলেছে একটাই শব্দ। তাহলে দ্বিমত কেন? আয়োজকদের পক্ষ থেকে যতই বলুক না কেন, থাকার অসুবিধা হবে, খাওয়ার অসুবিধা হবে, সর্বোপরি স্নানাগারেরও অসুবিধা হওয়ার আশঙ্কা আছে—আমি মনস্থির করে ফেললাম, যাব। 

ঘুরতে ভালোবাসি। অধিকাংশ সময় একাই ঘুরি। তবে এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে কি একা একা ঘোরা যাবে? তাই, এদের সঙ্গে গেলে রথ দেখা ও কলা বেচা দুটোই হবে। অর্থাৎ উৎসব পালন ও নির্মল প্রকৃতি দেখার সুযোগ। হলোও তাই। হাসি–আনন্দ, গান–গল্পে
অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে মুখর হয়ে থাকল দুটি দিন। গত ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি চেনা–অচেনা একঝাঁক
মানুষ নিয়ে মেতে উঠল উৎসবমুখর দিন দুটি।

স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়েই ছিল সূর্য উৎসবের একটি আয়োজন ‘বিজ্ঞান উৎসব’
স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়েই ছিল সূর্য উৎসবের একটি আয়োজন ‘বিজ্ঞান উৎসব’

৩০ ডিসেম্বর রাতে রওনা হয়ে সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছাই গন্তব্যে। এখন সব স্কুলে শীতকালীন ছুটি। তাই থাকার জায়গা হলো একটা বালিকা বিদ্যালয়ের দুটি ঘরে। ঘরগুলো আগে থেকেই পরিষ্কার করে রাখা হয়েছিল আমাদের জন্য। বেশ ভালো ব্যবস্থা। শৌচাগার স্কুলমাঠ পেরিয়ে যেতে হলেও পরিষ্কার। সবাই সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সকালের নাশতা পরোটা–ভাজি খেতে খেতেই সুখবরটা পেলাম। নবনির্মিত সরকারি গেস্টহাউসটা আমাদের জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছেন এখানকার চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ। থাকা এখানে, অনুষ্ঠান স্কুলে এই ব্যবস্থায় উৎসবের আয়োজন হতে লাগল। 

বেলা দুইটায় খাওয়া। তার আগে সবাই মিলে আশপাশটা ঘুরে দেখতে বের হলাম। ছিমছাম সুন্দর গ্রাম। রয়েছে সাফারি পার্ক, বৌদ্ধমন্দির, লেক ও অফুরান প্রাকৃতিক দান। ঝুলন্ত সেতু পার হয়ে ওপার থেকে পা–চালিত নৌকায় ঘুরে আশা লেকের এপার–ওপার। সবই উৎসবের অংশ। এবার মূল উৎসব। মধ্যাহ্ন আহারের পরপরই ঠিক করে দেওয়া হলো কে কী করবে। এতেই যুক্ত হয়ে গেল স্কুল হোস্টেলের ১৩ জন ছাত্রী। প্রতিবারের মতোই অতি উৎসাহে তৈরি হতে লাগল সূর্যমুকুট। ল্যাম্প শেড ও বেলুন ফোলানো। সঙ্গে গরম চা, কফি ও বিস্কুট। মনে হচ্ছিল এত আনন্দ বোধ হয় ওরা আগে কখনোই পায়নি। সব তৈরি, রাতের খাওয়াও শেষ। এবার অপেক্ষা। বর্ষবিদায়ের অপেক্ষা। এরই মধ্যে সারা মাঠে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। ঢেকে দেওয়া হলো হাতে বানানো শেড দিয়ে। অন্ধকার রাতে স্কুলজুড়ে এক মায়াবী দৃশ্য তৈরি হয়ে গেল। এবার বারোটা বাজতেই আকাশে একে একে উড়তে লাগল হাতে তৈরি কাগজের ফানুস। উৎসবের এই রূপ আগে কখনো দেখেনি এলাকার মানুষ। ভালো লাগার অভিব্যক্তি তাদের চোখে–মুখে। 

রাত কাটল। নতুন বছরের নতুন সূর্য দেখার উত্তেজনায় ঘুম নেই কারও চোখে। ঘড়িতে ছয়টা বাজতেই ওঠ ওঠ করে শীতের বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সবাই। ছেলে–বুড়ো সবাই। তাড়াতাড়ি শীতের বর্ম এঁটে হাতে হাতে বেলুন নিয়ে। মাথায় সূর্যমুকুট ও সোয়েটার পরে। জ্যাকেটের ওপর উৎসবের টি–শার্ট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল নতুন বছরের নতুন সূর্যকে বরণ করতে। বড় পুকুরটার পাড়ে সারি করে দাঁড়িয়ে পানিতে ভাসানো হলো বেলুন। ক্যামেরাও কথা বলল, এরপর সূর্য উৎসবের ব্যানার হাতে শোভাযাত্রা। আরও কাজ বাকি। সকালের নাশতা সেরে লেগে যাও কাজে।

উৎসবের সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেন স্থানীয় শিল্পীরা।
উৎসবের সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেন স্থানীয় শিল্পীরা।

আরও ছিল বিজ্ঞান উৎসব
সূর্য উৎসবের একটি অংশ বিজ্ঞান উৎসব। এই আয়োজনে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা কয়েকটা ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রকেট তৈরি করল। মহাকাশবিজ্ঞানের অনেক তথ্য জানল। বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে জানল। তারপর তাদের বানানো রকেট ও বিজ্ঞানীদের ছবি নিয়ে বাড়ি গেল। উপহার হিসেবে আরও পেল একটি টি-শার্ট।

আরও কয়েকটি দল ছবি আঁকল। কাগজ ও রং–পেনসিল অ্যাসোসিয়েশন থেকেই দেওয়া হলো। ভালো আঁকিয়েদের পুরস্কৃত করা হলো। পুরো সময়টাই কাটল উৎসবে–উৎসবে।

বিকেলের আয়োজন সাংস্কৃতিক উৎসব। চাক ও মারমা সম্প্রদায়ের মেয়েরা নাচল, গাইল। আদান–প্রদান হলো সংস্কৃতির। এবারও সূর্য উৎসবের সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো ও চ্যানেল আই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছে মাদল।