ভিনদেশি বরের বাঙালি বিয়ে

>
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কনে ফেরদৌসী কবির ও বর গ্রাহাম স্টুয়ার্ট। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কনে ফেরদৌসী কবির ও বর গ্রাহাম স্টুয়ার্ট। ছবি: সংগৃহীত
দুটি ব্যতিক্রমী বিয়ের আয়োজনের সাক্ষী হয়ে থাকল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বাংলাদেশি ফেরদৌসী কবির বিয়ে করলেন ব্রিটিশ নাগরিক গ্রাহাম স্টুয়ার্টকে আর আঁখি বড়ুয়া বিয়ে করলেন জাপানি তরুণ কিসুচি হায়াদোকে। বর ভিনদেশি হলেও বিয়ের আয়োজন হলো বাঙালি রীতিতে।

লন্ডনে পড়তে গিয়ে পরিচয়। সেই পরিচয় ভালো লাগায় রূপ পেতে দেরি হলো না। এমনি করেই বাংলাদেশি ফেরদৌসী কবির ও ব্রিটিশ গ্রাহাম স্টুয়ার্টের মন এক তারে বাঁধা পড়ল একদিন।

কিন্তু পারিবারিকভাবে বিয়ের কথা যখন উঠল, তখন যে বাধাগুলো এসেছিল সামনে, সেগুলোও ডিঙানো হলো। এবার ভৌগোলিক অবস্থান, আত্মীয়–পরিজন, বন্ধুবান্ধব, ভাষার দূরত্ব—সব পেছনে ফেলে গ্রাহাম ছুটে এলেন বাংলাদেশে। এমনই প্রেমের টান।

গ্রাহাম আর ফেরদৌসী নন শুধু, আরও এক তরুণ এই দেশে এসেছেন বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করতে। প্রেমিকাকে সারা জীবনের জন্য কাছে পেতে একেবারে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে এসেছেন জাপান থেকে। গত বছরের শেষ এবং নতুন বছরের শুরুর সপ্তাহে এমনি দুটি বিয়ের সাক্ষী থাকল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।

আজকাল পত্রিকার পাতা ওলটালেই বেরিয়ে আসে বাংলাদেশের ছেলেদের প্রেমের টানে বিদেশিনীদের এ দেশে আগমনের খবর! সেখানে প্রেমিকাকে বিয়ে করতে দুই তরুণের এই দেশে ছুটে আসা যেন একটু অন্য রকমই।

আঁখি বড়ুয়া ও কিসুচি হায়াদোর বিয়েতে জাপান থেকে এসেছিলেন হায়াদো পরিবারের সদস্যরা
আঁখি বড়ুয়া ও কিসুচি হায়াদোর বিয়েতে জাপান থেকে এসেছিলেন হায়াদো পরিবারের সদস্যরা

বিয়ের উৎসবের ফাঁকে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন ফেরদৌসী কবিরের বাবা হুমায়ুন কবির হেলালী। তাঁদের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে লন্ডনের নটিংহাম ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যান ফেরদৌসী। সেখানেই গ্রাহামের সঙ্গে তাঁর মেয়ের পরিচয় হয়। এরপর থেকে দুজনের নিয়মিত যোগাযোগ। সম্প্রতি পারিবারিকভাবে বিয়ের কথা উঠলে গ্রাহামের ধর্মের বিষয়টি সামনে চলে আসে। বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গ্রাহাম তাঁর নাম রেখেছেন সাইমন কবির। এরপর বাঙালি মুসলিম রীতি অনুযায়ী তাঁদের বিয়ে হয়।

ফেরদৌসী কবিরের পারিবারিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সামাজিকতার বিষয়টি গ্রাহামকে জানানোর পর তিনি এই দেশে এসে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য এর আগে লন্ডনে এক দফা বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে গ্রাহামের পরিবারের লোকজনও অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে গত ১৪ ডিসেম্বর তিনি এ দেশে আসেন। ওঠেন কনের নগরের লাভ লেন এলাকার বাসায়। বাঙালি রীতি অনুযায়ী ২৬ ডিসেম্বর দুজনের গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয়। ২৭ ডিসেম্বর দুজন বিয়ে করেন। ২৯ ডিসেম্বর নববধূকে সঙ্গে নিয়ে মাতৃভূমির পথে পাড়ি জমান গ্রাহাম। এর আগে অবশ্য নাচ-গানে মাতিয়ে যান শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে।

বিয়ে করতেই চট্টগ্রামে

আশির দশকে প্রথম জাপানে যাওয়া। তারপর থেকে ৩৫ বছর ধরে বাঙালি শিমুল বড়ুয়া ও সীমা বড়ুয়া থাকেন সূর্যোদয়ের দেশেই। নিজেদের দুই সন্তানের জন্ম, বেড়ে ওঠার ঠিকানার নামও জাপান। কিন্তু সে দেশের এক তরুণের সঙ্গে যখন মেয়ে আঁখি বড়ুয়ার বিয়ের কথা উঠল, বাঙালি দম্পতি বেয়াই বাড়ির লোকজনের প্রতি জুড়ে দিলেন একটিই শর্ত, ‘বাংলাদেশে এসে বাঙালি রীতিতেই আমাদের মেয়েকে উঠিয়ে নিতে হবে।’ সেই শর্তে এককথাতেই রাজি হলেন তাঁরা। তারপর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পরিবার–পরিজন নিয়ে ছুটে এলেন বর কিসুচি হায়াদো।

বাঙালি বধূ ও বরের সাজে আঁখি বড়ুয়া ও কিসুচি হায়াদো।
বাঙালি বধূ ও বরের সাজে আঁখি বড়ুয়া ও কিসুচি হায়াদো।

১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে হয় দুজনের গায়েহলুদের অনুষ্ঠান। খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি আর বাদামি রঙের ধুতিতে কিসুচিকে যেন লাগছিল এক বাঙালি তরুণই। তাঁর বাবা-মা ও দাদিও চিরকালীন জাপানি পোশাক ছেড়েছুড়ে উৎসবের দুই দিন মজে ছিলেন বাঙালির প্রিয় পোশাক শাড়ি-পাঞ্জাবিতে।
পরদিন বাঙালি রীতিতেই আঁখিকে বিয়ে করেন কিসুচি। ভরা উৎসবের মধ্যে এক হয়ে যায় দুই দেশের দুই বাসিন্দার চার হাত।

আর শুধু ছেলের জন্য বাঙালি মেয়ে পেয়ে খুশি হয়েছেন তা নয়, এই দেশের মানুষের সারল্য আর দরদও খুব টেনেছে কিসুচির পরিবারকে। তাঁর মায়ের কণ্ঠে যেন সেটিই খই হয়ে ফুটল। বললেন, ‘অবাক হয়েছি। এ দেশের মানুষ এতটা ভালোবেসে কাছে টেনে নেবে ভাবিনি।’

 ৩৫ বছর ধরে জাপানে থাকলেও মনটা এখনো বাংলাদেশেই পড়ে আছে বলে জানান আঁখি বড়ুয়ার মা-বাবা। বললেন, ‘সব সময় চেয়েছি ছেলে-মেয়েরা বাঙালি সংস্কৃতিতেই বড় হোক। মেয়ের বিয়েটাও বাঙালি রীতিতে দিতে পারলাম। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর নেই।’ মা-বাবার কথাতে সায় দিয়ে আঁখি বললেন, ‘নিজের দেশে এসে বিয়ে করছি। এর চেয়ে দারুণ কিছু হয় না আর।’

আঁখির আঙুলে আংটি পরাতে পরাতে কিসুচির ঠোঁটজুড়ে উপচে পড়ল হাসির ঝিলিক। গালভরা হাসি নিয়ে বাংলাতেই বলে উঠলেন, ‘এভাবে বিয়ে করতে পেরে ভালো লাগছে খুব।’