ডুবো ডুবো দ্বীপে আমরা দুজন

এই দ্বীপে গিয়েই বিপদে পড়েছিলেন লেখক। জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ার আগে তোলা ছবি।
এই দ্বীপে গিয়েই বিপদে পড়েছিলেন লেখক। জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ার আগে তোলা ছবি।

২০১৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন তখন মাত্র উপকূল অতিক্রম করেছে। আমি আর আমার নববিবাহিত স্ত্রী রীতু সেদিন কক্সবাজার যাব, মধুচন্দ্রিমায়। ঢাকায় তুমুল বৃষ্টি, ফ্লাইট দেরি হলো ঘণ্টাখানেক। কক্সবাজারে নেমে দেখলাম একদম খাঁ খাঁ রোদ। যদিও বিমান থেকে দেখছিলাম সমুদ্র ফুঁসছে, আকাশেও অনেক মেঘ।

আমাদের গন্তব্য ছিল কক্সবাজার শহর থেকে একটু দূরে, প্যাঁচার দ্বীপে একটি রিসোর্টে। রিসোর্টে দুপুরে খাবার সেরে ভাবলাম সৈকতে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। রিসোর্টের ঠিক সামনে থেকেই সৈকত শুরু। জোয়ারের সময় রিসোর্টের কাছাকাছি পানি চলে আসে, ভাটার সময় প্রায় আধা মাইলজুড়ে বালুময় সৈকত। যেহেতু রোদেলা বিকেল, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সৈকতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি আর ছবি তোলা। সমুদ্রের কাছাকাছি গিয়ে আমরা খুব আনন্দিত—কারণ, যত দূর চোখ যায়, লোকজন নেই, শুধু দূরে আমাদের মতোই এক দম্পতি সমুদ্রে সাঁতার কাটছে।

নাকিব শাহ আলম
নাকিব শাহ আলম

বিকেল পাঁচটার দিকে খেয়াল করলাম আকাশে মেঘ জমছে। শহরে যেমন মেঘ দেখা যায়, সে রকম নয় সেই মেঘ। ভীষণ কালো আর কেমন যেন ভয়–জাগানিয়া। দ্রুতই চারদিকটা কালো হয়ে গেল। আমরাও বুঝলাম, খোলা আকাশের নিচে থাকা ঠিক হবে না, ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফিরতে গিয়ে কিছু দূর হাঁটার পরই বুঝতে পারলাম, কিছু একটা গড়বড় হয়ে গিয়েছে। যেখান দিয়ে আমরা হেঁটে এসেছিলাম ঘণ্টা দুই আগে, সেখানে থইথই পানি, দূরে রিসোর্ট দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেখান পর্যন্ত যাওয়ার কোনো রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে কোনো এক সময় জোয়ার এসেছে এবং মাঝখানের এই জায়গাটা এখন সমুদ্র। আমরা একটা ছোটখাটো দ্বীপের মধ্যে আটকা। সেই জায়গাতেও ক্রমে পানি বাড়ছে, হয়তো আর ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে সেটাও তলিয়ে যাবে। ততক্ষণে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, অল্প অল্প বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে গায়ে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, সৈকতের যে জায়গাটাতে আমরা ছিলাম সেটা ডোবেনি অথচ পেছনের রাস্তা ডুবে গেছে, এটা কীভাবে হয়?
আশপাশে কাউকে দেখছি না, প্রথমে যে দম্পতিকে দেখেছিলাম, তাদেরও কোথাও দেখছি না। আকাশে তখন কানফাটানো শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। বাতাসও বেশ জোরে বইছে। অথচ ১৫-২০ মিনিট আগেও রোদেলা একটা ভাব ছিল।

আমি সাঁতার জানি না, কখনো শেখা হয়নি। রীতু শিখেছে, কিন্তু এ রকম উত্তাল সমুদ্রে সাঁতার কাটার সাহস ওর হবে না। পানি তখন কেবল বাড়ছে আর ফুঁসছে। আমি সামনে এগিয়ে পানির গভীরতা মাপবার চেষ্টা করলাম, পেট পর্যন্ত পানিতে যাওয়ার পরও আরও গভীর দেখে আমি আর সামনে যাওয়ার সাহস করলাম না। আমার সঙ্গে তখন ক্যামেরা, বাড়তি লেন্স, ট্রাই–পডসহ ভারী জিনিসপত্র। আমি কিছুই বুঝছিলাম না, কী করব। রীতুর দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, কারণ ওই মুহূর্তে পানিতে ডুবে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পরিণতি আমার মাথায় আসছিল না। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম এটাই শেষ। মানুষের মাথা খুব অদ্ভুত, এমন বিপদের মাধ্যেও আমি চারদিকের পরিবেশটা উপভোগ না করে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন পুরাণের কোনো ঝড়ের মধ্যে আটকা পড়েছি।

এরপর যে ঘটনা ঘটল, সেটারও কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। হঠাৎই দেখলাম যেন বায়ু ফুঁড়ে খুব লম্বা একজন জেলে আমাদেরও বেশ পেছন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আমরা চিৎকার করে তাঁকে ডাকতে লাগলাম, কিন্তু চারদিকে এত শব্দের মধ্যে তিনি আমাদের ডাক শুনতে পেলেন না। কিন্তু কপাল ভালো যে আমাদের হাত নাড়ানাড়ি দূর থেকে দেখতে পেলেন। মনে হয় সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলেন যে ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে, হয়তো আমাদের আগেও কোনো পর্যটক এই রকম ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।

বলতে গেলে লম্বা লম্বা পা ফেলে আর সাঁতরে কোনোমতে তিনি আমাদের কাছে চলে এলেন, পানি তখনো আমাদের ওখানে বেশি উঁচু হয়নি। তাঁর পা ফেলা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি জানেন কোন দিক দিয়ে গেলে বেশি উঁচু পানি পড়বে না। সে রকম কিছু জায়গা দিয়ে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন, কিন্তু তারপরও পানি পেট উঁচু পরিমাণ ছিল। রিসোর্টের কাছাকাছি নিয়ে যেতে তাঁর বেশ কয় মিনিট লেগে গেল। ততক্ষণে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে, আমরা ভিজে গেছি পুরোপুরি। রীতুর স্যান্ডেল রয়ে গেছে কোথাও পানির তলায়, প্যান্টের পকেটে রাখা আমার মুঠোফোনও সমুদ্রের নোনা পানিতে ভিজে বন্ধ হয়ে গেছে, কোনোভাবেই অন করা যাচ্ছিল না।

মানুষটাকে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব, আমার জানা ছিল না। একদম সত্যিকার অর্থে তিনি আমাদের জীবন বাঁচিয়ে দিলেন। আমরা তাঁকে কিছু টাকা দিতে চাইলাম, তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। পরে খেয়াল করলাম তাঁর নামটাও জিজ্ঞেস করিনি। আমার মাথা আসলে তখনো একদম কাজ করছিল না, বিশ্বাস হচ্ছিল না, এ রকম একটা বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছি। 

চিকিৎসক, অ্যাপোলো হাসপাতাল, ঢাকা।