অসমাপ্ত গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নাজমা ম্যাডামকে আমরা খুব পছন্দ করতাম। এই পছন্দের একটা বড় কারণ তাঁর অপরূপ সৌন্দর্য। অন্য কারণটা তাঁর ব্যক্তিত্ব। তিনি একটি কালো গাড়িতে করে স্কুলে আসতেন। তিনি স্কুলে পা রাখলেই পরিবেশটা বদলে যেত।

নাজমা ম্যাডাম বাংলা পড়াতেন। স্কুল পর্যায়ে বাংলাকে একটি মামুলি বিষয় হিসেবেই ধরা হয়। এই বিষয়ে ভালো নম্বর পাওয়া কঠিন হলেও ফেল নিতান্তই অসম্ভব ব্যাপার। নাজমা ম্যাডাম এই মামুলি বিষয়টি যখন পড়াতেন আমরা হারিয়ে যেতাম অন্য জগতে। তিনি যেদিন যে গল্প বা কবিতাটি পড়াতেন, সেদিন তেমন করে সেজে আসতেন। গল্প-কবিতার চরিত্রগুলো আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত।

আমরা প্রত্যেকেই চেষ্টা করতাম নাজমা ম্যাডামের ক্লাসের সেরা ছাত্র হতে। কারণ তাঁর প্রশংসা হাতছাড়া করার মতো বোকা আমরা কেউই ছিলাম না। ক্লাসের সবচেয়ে হাবাগোবা ছাত্রও শরৎচন্দ্রের ছদ্মনাম মুখস্থ করে আসত। ফলে এই একটা ক্লাসে সবাই ভালো ছাত্র ছিলাম। পড়া না পারলে নাজমা ম্যাডাম কোনো দিন বকা দিতেন না। শুধু বলতেন, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিই পড়া পারতেন না। তবু তাঁরা বিখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু এটাকে তুমি উদাহরণ হিসেবে নেবে না। সৃষ্টিকর্তা যাকে বিশেষত্ব দিয়ে পাঠান, সে এমনিতেই বিখ্যাত হয়। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের বড় হতে হলে পড়া শিখতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা তোমাকে বড় হওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে নেবে।

আমরা অবাক হয়ে ভাবতাম, নাজমা ম্যাডামও সাধারণ মানুষ! এটা কীভাবে সম্ভব!

এক বৃষ্টির দিনে তিনি ক্লাসে এসে ঢুকলেন। আমাদের বললেন, তোমরা কি জানো আজ বাংলা কত তারিখ?

আমরা বললাম, না।  

আজ বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দিনে জগতের মায়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আজ আমরা তাঁরই একটি কবিতা পড়ব।

আমরা লক্ষ করলাম তিনি একটি নীল শাড়ি পরে এসেছেন। তাঁর চোখে কাজল, চুলগুলো ছড়ানো এবং ঈষৎ ভেজা। তিনি কি ইচ্ছে করেই এই আয়োজনটি করেছেন? বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে প্রচণ্ড বেগে। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বাংলা বইটি হাতে নিয়ে বললেন, আজ পড়াব ‘বর্ষার দিনে’ কবিতাটি। বৃষ্টিদিনে মানব-মানবীর মনে যে সুতীব্র হাহাকার জাগ্রত হয়, তা নিয়ে রচিত কবিতার মধ্যে এটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।

তিনি পড়াতে শুরু করলেন। বৃষ্টি বাড়ছে। প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে। নাজমা ম্যাডাম পড়াচ্ছেন, ‘...যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে/ সে কথা আজি যেন বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

জন রাসেল
জন রাসেল

শ্রাবণের অবাধ্য মেঘ কবিগুরুর কবিতার মধ্য দিয়ে যেন প্রাণ পেয়েছে নাজমা ম্যাডামের ব্যক্তিত্বে। পড়ানো শেষ করে তিনি বললেন, এই কবিতা নিয়ে আমার নিজের জীবনের একটা হাহাকারের গল্প আছে। গল্পটা আমি কাউকে কোনো দিন বলিনি, কিন্তু তোমাদের আগামীকাল বলব।

পরদিন আমরা নাজমা ম্যাডামের জীবনের গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাংলা ক্লাসের সময় হয়ে এল। তিনি এলেন না। খবর নিয়ে জানা গেল তিনি স্কুলে আসেননি। তিনি পরদিনও এলেন না। নাজমা ম্যাডাম আর কোনো দিনই আসেননি।

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন এই শহরে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যাটা মোট কত? সেদিন একটা নীল শাড়ি পরা রক্তাক্ত শরীর পড়েছিল রাস্তায়। কবিগুরুর কবিতা নিয়ে নাজমা ম্যাডামের জীবনের গল্পটি আমাদের আর জানা হয়নি। একটি না–বলা গল্পকে ধারণ করে তিনি হারিয়ে গেছেন।

কল্পনায় ম্যাডামকে ভেবে আমি অসংখ্যবার আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। একটা আবছা বিষণ্ন অবয়ব ভেসে উঠেছে। সেখানে একজন শিক্ষিকা চক দিয়ে বোর্ডে জীবনের ব্যাকরণ লিখছেন। চকের সাদা গুঁড়োগুলো তাঁর চুলে এসে জমছে, তিনি বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। একটি ছেলে মনোযোগ দিয়ে খাতায় তুলছে বোর্ডের লেখাগুলো। ছেলেটির চুলের মাঝখানে সিঁথি করা। একসময় আমার মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়। জানালার ওপাশে একটি নীল আকাশ ছড়িয়ে আছে। এই আকাশটা যদি হঠাৎ মেঘ হয়ে যেত তবে আমার একটা বৃষ্টির গল্প সেই কবেই জানা হয়ে যেত। কিন্তু হয় না কেন?

ঢাকা।