বন্ধুত্বের প্রত্যয়

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাংলা দ্বিতীয় পত্র নিয়ে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, ব্যাকরণের প্রকৃতি ও প্রত্যয় অংশ নিয়ে যে ঝামেলা চলছে, তার একটা দফারফা করে তবেই উঠব! সেটা আর হলো না। মাঝরাতে না চাইতেও স্মৃতিগুলো বইয়ের অক্ষরগুলোকে ঝাপসা করে দিল।

এই তো সেদিন। এই প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের এক ক্লাসেই খুব খেপিয়েছিলাম একজনকে। যদিও তার ফল বেশ করুণই ছিল আমার জন্য। অভিযোগ নিয়ে সে সোজা প্রিন্সিপালের কক্ষে গিয়েছিল। এরপর যা হওয়ার তাই!  সাত বছর আগের সেই অভিযোগকারী বন্ধুটি ছিল প্রত্যয়। আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ আর ভালো বন্ধু। একে অপরের চোখের মণি তো ছিলামই, একই সঙ্গে চোখের বালিও। তার সঙ্গে কাটানো দেড় বছরের ওই স্কুলজীবনে গুনে গুনে সাড়ে সাত মাসই ছিলাম একে অন্যের চক্ষুশূল, বাকি সাড়ে সাত মাস চোখের আড়াল হলেই যেন ‘আহত’! আমাদের দুষ্টুমিতে রীতিমতো বিরক্ত ছিল সহপাঠী ও শিক্ষকেরা। আমাদের ক্লাসের রুটিন ছিল সবার চেয়ে আলাদা। প্রতিদিনই ক্লাসের প্রথম দুই ঘণ্টা একসঙ্গে, পরবর্তী দুই ঘণ্টা তুমুল গন্ডগোল পাকিয়ে ক্লাসের দুই মেরুতে, শেষ ক্লাসে আবার পিঠাপিঠি, সে এক অদ্ভুত রুটিন!

ছুটির দিনের বিকেল কেটে যেত বাইসাইকেলে নতুন সব জায়গা আবিষ্কারের অভিযানে। আঁকাআঁকির ক্লাসে একে অন্যের ছবিতে জল ঢালা, গালাগালির প্রতিযোগিতায় নামা, প্রতি ক্লাসে ন্যূনতম চার-পাঁচটি অভিযোগ দাখিল করা, একে অন্যের ইউনিফর্ম নষ্ট করা ছিল নিত্যদিনের বিষয়। একবার তো তাকে এমনই খেপালাম যে সে কাঁদতে কাঁদতে সোজা অধ্যক্ষের কক্ষে, সেবার স্কুলের বারান্দায় পুরো দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। যদিও পরে তা উশুল করে নিতে বেশি সময় লাগেনি আমার। সুযোগ বুঝে নাম টুকে দিয়েছিলাম। বেচারা সেদিন পুরো টিফিনের সময়টা ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু সেদিন তাকে ছাড়া আমার টিফিন ভেস্তে গিয়েছিল।

আশিকুর রহমান
আশিকুর রহমান

কত কাঁদিয়েছি দুজন দুজনকে, আবার এই হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরেছে। হাতাহাতি থেকে সাংঘাতিক, খুনসুটি থেকে দুর্ধর্ষ মাত্রার অ্যাডভেঞ্চার—বাদ যায়নি কিছুই। অল্প সময়েই দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিলাম আমরা। এরপর হঠাৎ একদিন সে নেই, কোনোরূপ পূর্বাভাস ছাড়াই সে উধাও। কত করে তার খোঁজ করেছি, অনেক খোঁজ করে জানতে পেরেছিলাম, কোনো এক পারিবারিক সমস্যার কারণে অনেকটা দূরে অন্য একটি শহরে চলে গেছে সে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।

সেদিনকার পরে কেমন যেন বদলে গিয়েছিলাম। প্রতিটি ক্লাসেই অনুভব করতাম প্রত্যয়কে। এরপরে ক্লাসে ওই আগের আমাকে কেউ দেখেনি। প্রিন্সিপালের রুম থেকেও ডাক আসেনি তেমন, কানগুলো সেবার হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। স্কুলের বারান্দাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগত, চুপচাপ ক্লাসে বসে বসে দমবন্ধ লাগত প্রায়ই।

মাঝখানে এতগুলো বছর গেল, এর মধ্যে ফোনে আলাপ হতো মাঝেমধ্যে, দেখা হলে বেশ একটা ঈদ ঈদ আমেজ চলে আসত।

সময়ের ব্যবধানে এখনো আমরা দুটি আলাদা শহরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে কথা হয়। তবে একটা অভ্যাস হয়েছে ইদানীং। মাঝেমধ্যেই হঠাৎ ব্যাগ-কাঁধে বেরিয়ে পড়ি, একটা ফোন কলে চমকে দিই বন্ধুকে। বাসার নিচে গিয়ে বলি, ‘দোস্ত, আমি তোর বাসার নিচে, রাতের ট্রেনে এসেছি। এক্ষুনি নিচে আয়!’

কেন্দুয়া, নেত্রকোনা।