চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়লাম

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

রাজধানীর ইট-কাঠ-পিচ পাথরে তখন সকালের স্নিগ্ধতা। সাতটা বাজে। পথের পাশের চায়ের দোকানিরা উনুনে পানি চড়িয়েছেন। অফিসমুখী মানুষ নিয়ে গাড়ির জটলা তখনো শুরু হয়নি। আমি জরুরি প্রয়োজনে যাচ্ছিলাম উত্তরার আজমপুরে। অবশ্য এমন জরুরি প্রয়োজনে প্রায়ই সেই এলাকায় যেতে হয়।

সেদিনের তারিখটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল। সে সময় ঢাকা সিটি কলেজের একটি বিভাগে স্নাতকে পড়ি। বাসা ছিল ধানমন্ডির একটি এলাকায়। বাসা থেকে বেরিয়ে সায়েন্স ল্যাবে এসেছিলাম বাসে ওঠার জন্য। আজিমপুর-গাজীপুর রুটের ভিআইপি–২৭ নামের বাসেই যাতায়াত ছিল ওই পথে। সেদিনও ওই একই পরিবহনের বাসে উঠেছিলাম।

বাসে উঠে যথারীতি নারীদের সংরক্ষিত আসনে গিয়ে বসি। বাসে যাত্রীসংখ্যা কম, মেয়ের সংখ্যা আরও কম। কর্মজীবী কয়েকজন নারী ছিলেন আমারই পাশে। সব মিলিয়ে ১৭ কি ১৮ জন যাত্রী তখন। বাসটি ফার্মগেট–জাহাঙ্গীর গেট–মহাখালী হয়ে নির্দিষ্ট পথে এগোচ্ছিল। পথে পথে যাত্রী নামল, উঠল। বনানী, খিলক্ষেত ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতই চলছিল। একসময় বিমানবন্দর হয়ে বাসটি উত্তরার রাজলক্ষ্মী পৌঁছাল। তখন সাড়ে সাতটার মতো বেজেছে। রাজলক্ষ্মীতে এসে একে একে বাসে যে কজন যাত্রী ছিলেন, সবাই নেমে গেলেন। আমি কয়েক গজ সামনেই নামব বলে দরজার পাশেই সামনের আসনটায় গিয়ে বসি। গেটলক বলে দরজা আলতোভাবে লাগানো। মুহূর্তেই খেয়াল করলাম, চালকের সহকারী আমার পাশের সিটে বসে পড়ল। তার গতিবিধি বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। আমি তাকে সিট থেকে উঠতে বললাম। সে কোনো কথা শুনল না। অগত্যা আমিই আসন থেকে উঠে বাস থামাতে বললাম চালককে। কিন্তু চালক যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। গতি বাড়াল। এদিকে সিট থেকে উঠতেই তার সহকারী আমাকে আটকানোর চেষ্টা করল। বাধ্য হয়ে পা দিয়ে তাকে সজোরে লাথি দিলাম। দরজা খুলে চলন্ত বাস থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে লোকটা এসে আমার জামা টেনে ধরল। আমি হ্যাঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিলাম। আমার কণ্ঠে তখন চিৎকার করার মতো শব্দ বের হচ্ছিল না। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল। জামা ছাড়িয়ে বাইরে লাফ দেওয়ার সময় লোকটা আমার চুল খামচে ধরল। তখন আমি বাধ্য হয়ে হাতে লুকিয়ে রাখা ছুরি দিয়ে আঘাত করি। সে চুল ছেড়ে দেয়। তখন চলন্ত বাস থেকেই লাফিয়ে পড়লাম রাস্তায়।

বাস থেকে নেমেই সামনে ট্রাফিক পুলিশ দেখতে পাই। দৌড়ে গিয়ে আমি তাকে জানাই, আমার সঙ্গে বাজে কিছু হয়েছে, বাসটাকে আটকান। তখনো আমার হাতে ছোট ছুরিটা। ট্রাফিক পুলিশ সেটা দেখিয়ে বললেন, আপনার হাতে ছুরি আছে, আপনিই এ মামলায় ফেঁসে যাবেন। তখন আর কিছু বলতে পারলাম না।

সে সময় গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির ঘটনা প্রায়ই ঘটছিল। যেহেতু একাকী পথ চলতে হয়, তাই ব্যাগে ছোট ছুরি বহন করতাম। আমার পরিচিত অনেকেই এটা করত, কাউকে কাউকে দেখতাম পেপার স্প্রে রাখছে ব্যাগে। সেদিন পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে
ব্যাগ থেকে ছুরিটি বের করে হাতে নিয়েছিলাম।

সেদিনের ঘটনার পর গণপরিবহনে উঠতে আমার ভীষণ ভয় হয়। 

নাসিমা জাহান (ছদ্মনাম)

ঢাকা