কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ঘর থেকে বেরোলেই আমাকে মোটরবাইক চালাতে হয়। দুই ছেলেকে স্কুলে পৌঁছানো, বাজার করা, কর্মস্থলে যাওয়া, সাহিত্য-সংস্কৃতি, এদিক–ওদিক দৌড়ঝাঁপ—আরও কত কী? বাইকের বদৌলতে জীবনে যে গতি এসেছে, সেখান থেকে পেছন ফেরার যেন কোনো উপায়ই নেই। আর এই বাইক চালাতে গিয়েই ঘটল ঘটনা। হঠাৎ একটা পথের কুকুর এসে পড়ে গেল চাকার তলায় আর অমনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি পিচঢালা পাকা রাস্তায়। কী ভয়াবহ বিপদ!

ঘটনাটা বিস্তারিতই বলি, বারটা ছিল রবি আর সকালটা ছিল শীতের। কুয়াশা ছিল না তবে হিম হিম একটা আবেশ ছিল। আকাশ ছিল গুমোট। সূর্যটা কিসে যেন ঢাকা পড়েছিল। শান্ত প্রকৃতি, বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠের পরে গ্রাম, রাস্তার ধারের দোকানপাট—সবকিছু পেছনে ফেলে চলছিলাম মুন্সিবাজারের পথে। চালাচ্ছিলাম আপন মনে। খুব তাড়া না হলে কখনোই পঞ্চাশের ওপরে চলি না। তবে আজ সকালে যখন মশরিয়া থেকে মুন্সিবাজার পর্যন্ত নতুন পিচঢালা পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম, তখন রাস্তাটা পুরো ফাঁকা ছিল। আমি যখন উঁচু একটা সেতুর ওপরে, তখন দেখলাম আমার ডান পাশে ঘন সবুজ গ্রাম অন্য পাশে ধানফলা ধু ধু মাঠ। তার বুক চিরে সুপ্রশস্ত সিলেট-ঢাকা হাইওয়ে। কী চমৎকার দৃশ্য! পৃথিবীটাকে খুব মোহনীয় মনে 

হলো। কে যেন আমাকে কানে কানে বলছিল, এ জন্যই তো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গেও যেতে চায় না। এসব ভাবতে ভাবতে আর না ভাবতে কখন যে গতিটা পঞ্চাশের খানিক ওপরে উঠেছিল, টের পাইনি।

মহিদুর রহমান
মহিদুর রহমান

তখনই চোখের পাতায় আতকা একটা কুকুর ভেসে ওঠে। তাৎক্ষণিক গতি কমিয়ে আনতে চেষ্টা করি। হাইড্রোলিক ব্রেক থাকায় বাইকটা থামে আর কুকুরটা রক্ষা পায় কিন্তু চালকের আসন ছেড়ে আমি একটা চলন্ত ফুটবলে পরিণত হই। পাক খেতে খেতে অন্তত পনেরো ফুট দূরে গিয়ে আমার শরীরটা থামে। তারপর উঠে দাঁড়াই। কোনো জনমানুষ নেই। নিজেকে তখন রেস জাম্পিংয়ের একজন দুর্দান্ত প্রতিযোগীর মতো লাগছিল। দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি। মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করি।

আমার মা বলতেন, বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে অনেকে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে শরীরের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের খোঁজখবর নিতে থাকি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য; প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই দৃঢ়তার সঙ্গে মস্তিষ্ককে জানান দিল যে তারা ঠিকঠাক আছে। হ্যাঁ, সব ঠিকঠাকই বলা যায়, তবে হাত আর পায়ের কয়েকটা জায়গা রক্তাক্ত। দেখলাম ছাল উঠে গেছে। তেমন ভয়ানক কিছু না। কীভাবে যে বেঁচে গেলাম, সে কথা ভেবে মনট কেমন স্তম্ভিত হয়ে গেল!

ডানে–বাঁয়ে তাকিয়ে বাইকের দিকে তাকাতেই দেখলাম, বেচারা বাইক নিঃশব্দে রাস্তার এক পাশে কেমন পড়ে আছে অসহায়। অথচ আমার হাতের স্পর্শে যেন প্রাণ ফিরে পায়। তবে বেটা কুকুরটা যে কোন দিকে গেল না–গেল, সে কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম!

গির্জাপাড়া, মৌলভীবাজার।