বাঁশের ভেলায় ভেসে

বাঁশের ভেলায় দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি।
বাঁশের ভেলায় দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি।

অসংখ্য বাঁশ বেঁধে তৈরি হয়েছে ভেলাটি। আদতে সেটা বাঁশের ভেলা। যাত্রী বলতে সবাই বাঁশের ভেলার শ্রমিক। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মাইনী নদীর বাবুপাড়া এলাকায় দেখা মিলেছিল যাত্রাবিরতিতে থাকা ভেলার যাত্রীদের। তাঁদের দায়িত্ব ভেলাটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। সেই গন্তব্য মাইনীমুখ এলাকার কাপ্তাই হ্রদ। তবে বাঁশের ভেলার সর্বশেষ গন্তব্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী পেপার মিলস। গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত বাঁশের ভেলাতেই কাটবে ভেলাবাসী ছয়জনের দিন-রাত।

শ্রমিকদলের মো. নূর হোসেন জানালেন, দীর্ঘ ভেলাটায় বাঁশের সংখ্যা ২৫ হাজার। তিনি তরকারি রান্না করছিলেন। ব্যস্ততার মধ্যেও দু-একটি কথা বলে যাচ্ছিলেন আগ্রহভরে। ৩৫ বছর বয়সী নূর হোসেনের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মরিয়ম নগরে। ছয় বছর ধরে বাঁশের ভেলা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন।

তাঁর আরেক সঙ্গী কালা সোনা চাকমা। ২৮ বছর বয়সী এই তরুণও রান্না করছিলেন। পলিথিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘরে (পং নামে পরিচিত) রান্নার জন্য পাতিলে চাল তুলে দিচ্ছিলেন। বাকি চারজন নদীতে গোসলে ব্যস্ত।

এরকম দীর্ঘ বাঁশের ভেলা বয়ে নিয়ে চলেন শ্রমিকেরা। ছবি: লেখক
এরকম দীর্ঘ বাঁশের ভেলা বয়ে নিয়ে চলেন শ্রমিকেরা। ছবি: লেখক

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সবার সঙ্গেই আলাপ হলো। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, নাড়াইছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বাঁশগুলো কাটা হয়। তারপর পাহাড় থেকে বিভিন্ন ছড়া দিয়ে মাইনী নদীতে আনা হয়। নদীতে বাঁশ আনার পর ভেলা তৈরির শ্রমিকেরা ৫০টি বাঁশ সংযুক্ত করে একটি ভেলা তৈরি করেন। দুটি ভেলা পাশাপাশি করে সারিবদ্ধভাবে একটির সঙ্গে আরেকটি বেঁধে লম্বা ভেলা তৈরি করা হয়। ভেলা তৈরি শেষে নাড়াইছড়ি থেকে কয়েকজন শ্রমিক ভেলাটি ভাসিয়ে ৩০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে মাইনী নদী দিয়ে ধনপাতা এলাকায় অন্য শ্রমিকদের কাছে হস্তান্তর করেন। ধনপাতা থেকে কয়েকজন শ্রমিক ১৫ কিলোমিটার মাইনী নদীপথে ভেলা ভাসিয়ে মাইনী বেইলি সেতু এলাকায় অন্য শ্রমিকদের কাছে হস্তান্তর করেন। এভাবেই শ্রমিকদের হাতের পর হাত বদলে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় কর্ণফুলী পেপার মিলসে।

মো. জাফর নামে এক ভেলাশ্রমিক বললেন, ‘এ কাজে আমরা তিন শতাধিক শ্রমিক কাজ করি। কিন্তু কাগজকলের দুরবস্থার কারণে এখন আর তেমন একটা বাঁশ নদীপথে যায় না। আমরা শ্রমিকেরা অনেকটা বেকার ও মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি।’

এই ভেলার শ্রমিকসরদার সমর বিজয় চাকমা। তিনি জানালেন, নদীতে পানি থাকলে প্রতি হাজার বাঁশ মাইনীমুখ পৌঁছে দিলে মজুরি পান ৪ হাজার টাকা। সময় লাগে ৬ থেকে ৮ দিন। পানি কম থাকলে মজুরি পান ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। তখন সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন।

এই কটা দিন সুখে-দুঃখে সবাই থাকেন পরিবারের সদস্যের মতো। যেমনটি নূর হোসেন বলে গেলেন, ‘ভেলায় আমরা ২ জন বাঙালি, ৪ জন পাহাড়ি। তবে আমরা ভাইয়ের মতো। ১০-১২ দিন একই সঙ্গে থাকব, একই রান্না খাব।’