ভালোবাসায় হলো বৃদ্ধাশ্রমের ভালো বাসা

অসহায় মানুষদের জন্যই ভালোবাসার উদ্যোগের তৈরি ঘর। ছবি: সংগৃহীত
অসহায় মানুষদের জন্যই ভালোবাসার উদ্যোগের তৈরি ঘর। ছবি: সংগৃহীত

তরুণ দলটির উদ্যোগের নাম—ভালোবাসার উদ্যোগ। মূলমন্ত্র ‘ভালোবাসায় ভালো থাকব সবাই’। অর্থাৎ যাঁরা ভালো নেই, যাঁরা দুস্থ, তাঁদের পাশে দাঁড়াবেন, ভালোবেসে সহায়তার হাত বাড়াবেন। সেই ভালো রাখার প্রত্যয়েই গোপালগঞ্জে একটি বৃদ্ধাশ্রমে গড়ে দিলেন একটি এক তলা পাকা ভবন। গত ১৪ ডিসেম্বর ছিল ঘরটির উদ্বোধনের আয়োজন। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের পথে সঙ্গী হয়েছিলাম ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়া এই যাত্রীদের। যেতে যেতেই শুনছিলাম ‘ভালোবাসার উদ্যোগ’ প্রতিষ্ঠার কথা।

২০১৬ সালের কথা। দুর্গাপূজার সময় তখন। একটি জাতীয় দৈনিক খবর ছেপেছে, টাঙ্গাইলের একটি অনাথ আশ্রমে খাবারের কষ্টে ভুগছে কিছু শিশু। তরুণ অনুজ ভৌমিকের মনটা খুব কেঁদে উঠল পাশে দাঁড়ানোর তাগিদে। পরক্ষণেই ভাবলেন, একা কতটুকুই–বা করতে পারেন তিনি। তার চেয়ে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করা যায়। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৭ সালে একটি ফেসবুক গ্রুপ চালু করেন। নাম দেন ‘ভালোবাসার উদ্যোগ’। পেশায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উপপরিচালক সেই গ্রুপে যোগ করে নেন বন্ধুতালিকায় থাকা অনেককেই।

২০১৭ সালের দুর্গাপূজায় আর হতাশ হতে হলো না অনুজকে। পরিবারের সদস্য, ফেসবুক গ্রুপের কয়েকজন সুহৃদসহ সীতাকুণ্ডের শংকর মঠ অনাথ আশ্রমে হাজির হলেন। ৩৬ জন অনাথ শিশু-কিশোরকে পূজার নতুন পোশাক ও জগৎপুর অনাথ আশ্রমের ১৫০ জনের জন্য খাবারের আয়োজন করলেন। তখন থেকেই শুরু হয় ভালোবাসার নানা উদ্যোগ। এ বছর সংগঠনের অনুদানকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩০ জনে। ইতিমধ্যে তাঁরা ঢাকা অরফানেজ সোসাইটির ৭০ জন শিশু-কিশোরকে নতুন পোশাক, শিক্ষা ও খেলাধুলার উপকরণ বিতরণ করেছেন। যুক্ত হয়েছেন আরও কিছু স্বেচ্ছাসেবার কাজে।

এরপরই উদ্যোগী হন বৃদ্ধাশ্রমের ঘরটি গড়ে দেওয়ার জন্য। হাইশুর বৃদ্ধাশ্রমটি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার রাহুথর ইউনিয়নের হাইশুর গ্রামে। ১৯৯৬ সাল থেকে বৃদ্ধাশ্রমটি পরিচালনা করেন গ্রামের আশুতোষ বিশ্বাস। বৃদ্ধাশ্রমে বর্তমানে ২২ জন সদস্য। বছরের ২৪০ দিন তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করেন বৃদ্ধাশ্রমের ২৪০ জন সদস্য। অন্য দিনগুলোর আর আনুষঙ্গিক খরচ জোগাতে আশুতোষ বিশ্বাস বাদ্যযন্ত্র নিয়ে পথে–ঘাটে গানবাজনা করেন। শুরুর দিন থেকেই বৃদ্ধাশ্রমবাসীদের থাকা-খাওয়া, সেবা-শুশ্রূষাসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। এই খবর জেনেছিলেন ভালোবাসার উদ্যোগের সদস্যরা। তারপরই এগিয়ে আসেন ঘর তুলে দেওয়ার জন্য। অনুদান দিতে এগিয়ে আসেন ১৩১ জন। তাঁদের দেওয়া প্রায় ৪ লাখ টাকায় তৈরি হয় ৪০০ বর্গফুটের ঘরটি। 

সেদিন বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছাতেই স্বাগত জানিয়েছিলেন আশুতোষ বিশ্বাস। বৃদ্ধাশ্রমে ঢুকে দেখা গেল, আশ্রয় পাওয়া ব্যক্তিরা বসে আছেন। তাঁদের চোখে-মুখে রাজ্যের কৌতূহল। আশুতোষ তাঁর পাশে পেয়েছেন স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী মনিকা রানী বোসকে। স্বামীর কাজ সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ‘মানুষের সেবা-শুশ্রূষা করা আমার স্বামীর একটা নেশা। তার স্কুলের চাকরিটা যখন গেল, সে নতুন চাকরির খোঁজ না করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ মানুষের সেবা করত।’

আশুতোষ বিশ্বাস জানালেন, সহযোগিতার জন্য তিনি হাত পেতেছেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তেমন সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। সরকারি নিবন্ধন থাকলেও বৃদ্ধাশ্রমের জন্য কোনো তহবিল পান না। খাবার আর পোশাক জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁকে, এর মধ্যে পাকা ঘরের স্বপ্ন তো ছিল কল্পনাতীত।

আশুতোষ বিশ্বাসের সেই স্বপ্নই পূরণ হলো ভালোবাসার উদ্যোগে।