পাথর গড়িয়ে পড়ল বুকে

দুর্ঘটনার আগে মানালির সোলাং উপত্যকায় লেখক। ছবি: সংগৃহীত
দুর্ঘটনার আগে মানালির সোলাং উপত্যকায় লেখক। ছবি: সংগৃহীত

ভারত ভ্রমণে সেদিন ছিল আমাদের অষ্টম দিন। তখন আমরা মানালিতে। নির্মল প্রকৃতির মতো আমরাও উদাস হয়ে গেলাম। আমরা বলতে ভ্রমণসঙ্গী তিন বন্ধু পিয়েল, বাপ্পী আর পাপলু। সেদিন দলেবলে গেলাম সোলাং উপত্যকায়।

একসময় খেয়াল করলাম গাড়ি যতই ওপরে উঠছে ততই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রতিটি পথের বাঁকে প্রকৃতির দৃশ্যপটের বদল। মাঝখানে অবশ্য একটা দোকান থেকে বিশেষ পোশাক ও জুতা ভাড়া করে নিলাম। বরফে গড়াগড়ি খেতে হলে এই পোশাক পরতে হয়। পর্বতগুলোকে অদ্ভুত লাগছিল, বরফের মুকুট পরা একেকটা রাজকুমার যেন। ঘন নীল আকাশের পটে ভেসে আছে সাদা মেঘের টুকরো, নিচে সোনালি, হলুদ, বাদামি রঙের পর্বতের সারি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ হাজার ফুট ওপরে সোলাং উপত্যকা। আমরা যে চূড়ায় উঠেছি, তা নিচ থেকে হেঁটে প্রায় আড়াই কিলোমিটার ওপরে উঠতে হয়েছিল। যেখানে শারীরিকভাবে দুর্বল, বৃদ্ধ ও শিশুরা ঘোড়ায় চড়ে ওঠেন। সেদিন বুঝলাম আমার মতো অলস মানুষের জন্য পর্বত আরোহণ সত্যিই কষ্টের।

সেই কষ্ট মেনে নিয়েই অবশেষে বরফ ছোঁয়ার সুযোগ এল। প্রথম এত বরফ একসঙ্গে দেখা। তাই নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। দৌড়ে ওপরে উঠি একবার, শাঁই করে নিচে নামি আরেকবার। বরফে নাচি, বরফে শুয়ে থাকি। শুরু হলো বরফকেলি!

ততক্ষণে প্রায় তিন ঘণ্টা কেটেছে বরফরাজ্যে। তবু আমাদের বরফকেলি থামেনি। ঠিক তখনই ঘটল এক ভয়ংকর ঘটনা। সোলাং উপত্যকায় স্নো পয়েন্টে শিবলিঙ্গের কাছেই আমরা হাঁটছিলাম। সূর্য নেমে আসছিল। হুট করে মাথায় ভূত চাপল, এই ঠান্ডায় গরম জামাকাপড় খুলে ছবি তুলব। পিয়েল আমার ছবি তুলছিল। আমি এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফ দিলাম। পেছনের পাথরে পা ফসকে দ্রুম করে নিচে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে আমি পেছনের পাথরটিকে ছাড়লেও সে পাথর যেন আমাকে ছাড়ল না। গড়িয়ে আমার বুকের ওপর চলে এল। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মনে হচ্ছিল এই বুঝি প্রাণপাখি উড়াল দিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞান হারালাম। যখন চোখ মেললাম, ঝাপসা চোখে দেখি আমার তিন বন্ধু বুকের ওপর থেকে পাথর সরাচ্ছে।

ততক্ষণে পেট ও ঊরু কেটে রক্ত ঝরছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই ভড়কে গেল। বরফ ছেড়ে এক্ষুনি হোটেলে ফিরতে হবে, তবে সবার আগে হাসপাতাল। প্রায় তিন কিলোমিটার নিচে আমাদের ট্যাক্সি। পাপলু আর বাপ্পী দৌড় দিল ঘোড়া সংগ্রহের জন্য, আহত শরীরটাকে বয়ে নিতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। পিয়েল আমার ব্যাগ, ক্যামেরা নিজের কাঁধে তুলে নিল। একটা লম্বা দম নিলাম তারপর আমি গড়িয়ে, বসে বসে, পর্বত থেকে নামতে শুরু করলাম। বরফে পা ঢুকে যাচ্ছে, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।

আধঘণ্টা পর দুটো ঘোড়া ম্যানেজ হলো। গব্বর নামে ঘোড়ায় আমাকে চড়িয়ে, কালিয়া নামের ঘোড়ায় উঠে বসল পিয়েল। হেঁটে ফিরছে বাপ্পী, পাপলু। একসময় তোলা হলো ট্যাক্সিতে। চালক দ্রুত নিয়ে চললেন মানালির হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে নেওয়া হলো। বুকের এপাশ–ওপাশ এক্স-রে করা হলো। চিকিৎসক নিশ্চিত করলেন বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।

মনে হলো, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।

লেখক: সহকারী পরিচালক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।