শুয়ে পড়েছিলাম দুই বাসের চাকার ফাঁকে

আব্দুল ইলা
আব্দুল ইলা

সময়টা ২০১১ সাল। মাত্রই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফলাফল প্রকাশের অপেক্ষায় যে অবসর, তার প্রতীক্ষা তো ছিল দীর্ঘদিনের। কত–কি যে করব ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু দিনগুলো চলে যাচ্ছিল চোখের পলকে! তার মধ্যেও প্রথম যে কাজটি শুরু করেছিলাম, তা হলো অভিনয়। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল, তাই ওই সময়ে একটা নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই।

নাট্যদলের কাজ হতো রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের একটি কক্ষে। অনুশীলনের জন্য সপ্তাহে তিন–চার দিন যেতে হতো সেখানে। তবে দলের কোনো নাটক মঞ্চায়নের তারিখ ঘনিয়ে এলে প্রতিদিনই হাজিরা দিতে হতো।

তখনো আমাদের বাসা ছিল গেন্ডারিয়ায়। এমনই একদিন অনুশীলনের জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। উঠেছিলাম বাসে। যাত্রীও ছিল অপেক্ষাকৃত কম। সম্ভবত দিনটি ছিল শনিবার, তাই রাস্তা বেশ ফাঁকা মনে হলো। বাসচালক ফাঁকা রাস্তার যথাযথ ব্যবহার করলেন। বাসের গতি দেখে একেকবার মনে হলো, যেন হাইওয়েতে কোনো বাসে চলছি। তাই অল্প সময়েই চলে আসি মৎস্য ভবন এলাকায়। সামনেই টেনিস ফেডারেশন। আমি গন্তব্যে নামিয়ে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই চালকের সহকারীকে বললাম। বাস ততক্ষণে শাহবাগে শিশুপার্কের একটু আগে। বাসের গতি কমালেন চালক, কিন্তু পুরোপুরি থামল না। হেলপার বলল, ‘তাড়াতাড়ি নামেন, তাড়াতাড়ি নামেন।’

নামতে গিয়ে পেছনে দেখে নিলাম কোনো বাহন আছে কি না। বাসের গতি তখন একদমই কম। টুপ করে নেমে পড়লাম। নামার মুহূর্তে অনেকটা দূরে যে আরেকটা বাসকে দেখেছিলাম, তখন সেই বাসের যে গতি ছিল, তাতে আমি নিরাপদেই ফুটপাতে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি নামতেই দূরে থাকা বাসটা গতি বাড়িয়ে যেন উড়ে এল আমার কাছে। এদিকে আমাকে বহনকারী বাসটাও কেবলই গতি বাড়াবে বাড়াবে অবস্থায়। মুহূর্তেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম দুই বাসের মধ্যে।

অংলকরণ: তুলি
অংলকরণ: তুলি

এরপর আসলে আমি কী করেছি, কেনই–বা করেছি, সেটা স্পষ্ট মনে নেই। তবে ধীরগতিতে (স্লো মোশন) মনে করতে পারি, দুটো বাস একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে যাচ্ছিল। আমি শরীরটা ঘুরিয়ে নিয়ে সংকুচিত করেছিলাম। বাসটা আমার গায়ে লেগে যাওয়ার মুহূর্তে পিচঢালা সড়কে লুটিয়ে পড়ি। দুই বাসের ওপরের অংশ ছুঁই ছুঁই করলেও চাকা বরাবর একটি ফাঁকা ছিল, সেই ফাঁকা অংশে কসরত করে শুয়ে পড়ি (বাসের কাঠামো পাশ দিয়ে একটু বাঁকানো থাকে
বলে দুই বাসের চাকার অংশে একটু দূরত্ব থাকে)। তখন অন্য বাসটা ভোঁ করে চলে যায়, আমি যে বাসে ছিলাম সেটাও কিছুদূর গিয়ে থামে। দুই বাসের যাত্রীরা ভেবেছিল আমি হয়তো চাপা পড়েছি। সবাই শঙ্কিত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল।

আমিও আকস্মিক ঘটনায় ধাতস্থ হতে পারছিলাম না। কিংবা বুঝতেই পারছিলাম না কী ঘটে গেল। অথবা ঠিক সেই সময় ভাবছিলাম, আচমকা যা ঘটে গেল আদতে এমন কিছু আমার জীবনে ঘটেনি। বাস সরে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াই। তারপর গিয়ে ফুটপাতে উঠি।

সেদিনের ঘটনার এই বর্ণনা আমি অনেক পরে মনে করতে পেরেছি। কারণ, অনেক দিন আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি বেঁচে ফিরেছি। ঘটনাটি এত অল্প সময়ে ঘটেছে, বর্ণনা দেখে হয়তো মনে হয় কোনো চলচ্চিত্রের একটি
অংশের স্লো মোশন দেখছি। তবে আজও আমি ভেবে পাই না, দুই চাকার মধ্যে যে ফাঁকা থাকে, সেটা আমি কীভাবে বুঝেছিলাম, কেনই–বা আমি শুয়ে পড়েছিলাম। সম্ভবত তাৎক্ষণিকতাও আমাদের অনেক কিছু শেখায়, আকস্মিক সিদ্ধান্ত দেয়।