আমিও বাবা

সন্তানের সঙ্গে লেখক
সন্তানের সঙ্গে লেখক

বয়স তখন কতই হবে, ৮ কি ৯। স্কুলে পড়ি। আমরা যমজ ভাই প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। বাবা প্রতিদিনের জন্য ৮ টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন রিকশা ভাড়ার জন্য। গ্রাম থেকে শহরের স্কুলটা অনেক দূরেই ছিল। হেঁটে বাড়ি ফিরে ভাড়া বাঁচাতাম। সেই টাকায় আমরা একটা করে শিঙাড়া খেতাম তৃপ্তি নিয়ে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কখনো একটার বেশি শিঙাড়া খাওয়া হতো না।

পয়লা বৈশাখে দূরের গ্রামে মেলা বসত। খেলনার সমাহার থাকত মেলায়। মেলার জন্য দুই ভাই ২০ কি ৩০ টাকা করে পেতাম। সেই টাকায় খেলনা না কিনে বাড়িতে খই আর বাতাসা নিয়ে ফিরতাম। মা খুশি হতেন। খাবার না কিনে খেলনা কেনা যে পয়সার অপচয়, এই বোধ আমরা পেয়েছিলাম মা-বাবার কষ্ট দেখে। মাকে কখনো দামি কাপড় পরতে দেখিনি। বাবা একটি মাত্র শার্ট-প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরে বছরের পর বছর পার করে দিতেন। অভাবের সংসারে প্রায় সপ্তাহেই মা-বাবার ঝগড়া লাগত।

খেলনা না কিনে খাবার কিনলেও বাবার পরিশ্রম তখন অতটা বুঝিনি। এখন বুঝি। ছোট পদের সরকারি চাকরি করে আমাদের তিন ভাইয়ের খরচ চালাতে তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অফিসে যাওয়ার আগে ধান সেদ্ধ করতেন। মা রোদে শুকানোর কাজ করতেন। এই কাজটা মাকে বছরে দুবার করতে হতো, অগ্রহায়ণ ও ভাদ্র মাসে। সেই শুকানো ধান আমরা কাঁধে বা মাথায় নিয়ে পাশের গ্রামে যেতাম ভাঙানোর জন্য।

মাধ্যমিকে ওঠার পর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সাইকেল কিনেছিলাম। তখন যদি বুঝতাম, বাবা কী কষ্ট করে বাইসাইকেল কিনে দিয়েছেন, তাহলে হয়তো কিনতে চাইতাম না। তবে এখন আমরা প্রতিষ্ঠিত। ছোট ভাই পরবাসী। আমি স্নাতক পড়ার সময় চাকরি শুরু করেছিলাম। আমার যমজ যে জন, সে-ও স্নাতকোত্তর। মা-বাবাকে হয়তো বিলাসবহুল জীবন দিতে পারিনি। তবে তিন বেলা দুমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা দিতে পেরেছি।

আজ আমিও বাবা হয়েছি, আমি বুঝি বাবা শব্দটা অনেক ত্যাগের। বাবা মানেই শত কষ্টের মধ্যে সন্তানের হাসিমাখা মুখ।