চাটমোহরের ভ্যানচালক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

২০০৬ সালের এক রাতের কাহিনি আমার মানসপটে এখনো সজীব। ঘটনাটি একই সঙ্গে ভয় এবং আস্থার।

তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা পদে যোগ দিয়েছি পাবনার চাটমোহরে। শীতের এক দুপুরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চেপে বসেছি। সুন্দরবন এক্সপ্রেস সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ চাটমোহর পৌঁছানোর কথা। স্টেশন থেকে উপজেলা সদরের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। প্রায় সময়ই রিকশা–ভ্যান চলে। এ ছাড়া পাবনা চাটমোহরের মধ্যে চলাচলকারী বাসেও রেলস্টেশন থেকে উপজেলায় যাতায়াত করা যায়।

ট্রেন সেদিন ঠিক সময়ে চাটমোহর স্টেশনে পৌঁছাল না। আমি যখন ট্রেন থেকে চাটমোহর রেলস্টেশনে নামলাম, তখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। স্টেশনে আমার সঙ্গে আরও ৩ কি ৪ জন যাত্রী নামলেন। শীতকাল, প্রচণ্ড শীত পড়েছে, সঙ্গে কুয়াশা। আমার বাড়ি বরিশাল বলে উত্তরবঙ্গের এমন জাঁকালো শীতের সঙ্গে সম্পর্ক সেই প্রথম। সুদূর প্রসারিত চলনবিলের মাঝখানে চাটমোহর উপজেলার অবস্থান। বিল এলাকা বলেই হয়তো শীতের প্রকোপ বেশি অনুভূত হচ্ছিল। এক–দুই হাত সামনেও কুয়াশার কারণে কিছু দেখা যায় না।

এমন শীতের কারণে স্টেশনে কোনো রিকশা দেখলাম না, সব দোকানপাট বন্ধ। এত রাতে পাবনা থেকে বাস আসার কোনো সম্ভাবনাও নেই। একটা ভ্যান আছে। ট্রেন থেকে আমার সঙ্গে নামা যাত্রীরা ভ্যানে চড়ে বসলেন। ভ্যানটা চাটমোহর হয়ে যাবে। ভ্যানটা চলে গেলে কুয়াশায় ঢাকা তীব্র শীতের রাতে আমাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমি ভয়ে ভয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে ভ্যানের এক কোনায় বসলাম।

চলনবিলের মধ্য দিয়ে রাস্তাটি বয়ে চলছে চাটমোহরের দিকে, দুই পাশে খোলা প্রান্তর, ফসলি মাঠ, অন্ধকার। আমার মানসপটে ভেসে উঠছিল ইয়াসমীনের কথা, দিনাজপুরের সেই ইয়াসমীন, গভীর রাতে ইয়াসমীনকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ভ্যানের যাত্রীরা ছিলেন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী ধরনের। আলোচিত সেই ঘটনা মনে হচ্ছিল আর ভয় জেঁকে বসছিল।

আমার একবার মনে হলো টুকুন ভাইকে ফোন দিই, তিনি তাঁর মোটরসাইকেল নিয়ে চলে আসবেন, এই বিশ্বাস আমার ছিল। এত রাতে এভাবে সাহায্য চাওয়া, উপজেলার কেউ দেখলে অন্য রকম কিছু ভাবতে পারেন, এত রাতে একটা ছেলের পেছনে চড়াটাও স্বস্তিকর মনে হলো না। ইউএনও স্যারকে ফোন দিলে স্যার একটা ব্যবস্থা হয়তো করবেন, কিন্তু ঠিক কাউকে বিরক্ত করতে মন চাইল না। আমি ভয়ে ভয়ে
ভ্যানে উঠলাম, আমার মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল, এঁরা এতটা নৃশংস হবেন না, শ্রমজীবী মানুষকে একজন কার্ল মার্ক্স
পড়া মানুষ তো এতটা অবিশ্বাস করতে পারে না।

পথে কোনো সমস্যা হলো না। ততক্ষণে ভ্যান উপজেলার মধ্যে প্রবেশ করল। আমার সব শঙ্কা কেটে গেল, ভ্যান এসে থামল উপজেলার ফটকে। আমি ভ্যান থেকে নামলাম, ভাড়া দিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার, মনে হয় বিদ্যুৎ ছিল না। এবার ভ্যানচালক আমাকে বললেন, ‘আপা, আমি কি হারিকেন নিয়ে আপনাকে এগিয়ে দেব?’

উপজেলার মূল ফটক থেকে কোয়ার্টার পর্যন্ত বেশ খানিকটা পথ ঘুরে যেতে হয়, গাছপালা অনেক বেশি আর কোয়ার্টারও প্রায় লোকশূন্য। আমার ‘না’ বলার কোনো প্রশ্নই আসে না। তিনি আমাকে আরও বললেন, ‘আপা আমি আপনাকে চিনেছি, আপনি স্টেশন থেকে সব সময় আসা–যাওয়া করেন।’ ভ্যানচালক তাঁর ভ্যান রেখে হারিকেনটা হাতে নিয়ে আমাকে কোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। তখনো মফস্বলে রিকশা-ভ্যানের নিচে হারিকেন জ্বালিয়ে চলতে হতো।

আজ এত দিন পরও সেই ভ্যানচালকের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা–শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। তবে তাঁর চেহারা আমি মনে রাখতে পারিনি। সেদিন আমি তো তাঁর চেহারা দেখিনি। পরে মনে মনে চাটমোহরে তাঁকে আমি খুঁজেছি, কিন্তু আর ঠাহর করতে পারিনি। আজ আমার মনে হয়, সেদিন সেই ভ্যানচালক আমার প্রতি দেখিয়েছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন মানুষের দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা।