অলোকের স্কুল

নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অলোক চন্দ্র দাস। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অলোক চন্দ্র দাস। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সন্ধ্যা নামতেই কেমন আনমনা হয়ে ওঠে জহির মল্লিক। সে মাছ রপ্তানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানে কার্টন বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে। বারবার তাগাদা দিয়েও তার কাজে মনোযোগ ফেরাতে পারেন না মহাজন। চালান বোঝাইয়ের সময় কাজের চাপ বাড়ায় প্রায় সব কর্মীকে দিয়েই বাড়তি সময় কাজ করাতে হচ্ছে তাঁর। ১০ কি ১৫ দিন ধরেই খেয়াল করছেন তিনি, কয়েক দিন চিৎকার করেও বলেছেন, কিন্তু আজ কী মনে করে ছেলেটিকে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন অন্যমনস্ক থাকার কারণ। কথায় কথায় জেনে নিলেন জহির অনুশীলন মজার স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেদিনের মজুরি মিটিয়ে জহিরকে ছুটি দিলেও মহাজন কিছুতেই ভেবে পান না, হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেটিকে কেন টানছে সেই স্কুল, কেন লোভনীয় মজুরি তার মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না?

অনুশীলন মজার স্কুলে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে কবিতা, গান, খেলাধুলা ও গল্পের ছলে শিশুদের পাঠদান করা হয়। তাই তো শিশুরা আনন্দের সঙ্গে স্কুলে আসতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়েই ছিন্নমূল শিশুদের শেখানো হয় শৃঙ্খলাবোধ, আচার-আচরণ, ভালো ও মন্দ কাজের পার্থক্য, নৈতিকতা সৃষ্টি, মনন বিকাশ। এ ছাড়া কর্মজীবী শিশুদের নিয়মিত স্কুলে আসতে উৎসাহিত করতে এবং আগ্রহ বাড়াতে প্রতিদিন মজার মজার নাশতার ব্যবস্থা করা হয়। বছরে দুবার শিক্ষাসফর, ঈদে নতুন পোশাক, শীতে শীতবস্ত্র, বার্ষিক সব শিক্ষা উপকরণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার ফলে অনাদরে–অবহেলায় বেড়ে ওঠা শিশুরা পায় ভালোবাসার পরশ।

অনুশীলন মজার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অলোক চন্দ্র দাস। স্কুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনিই গল্পগুলো শোনাচ্ছিলেন। জানালেন, ২০১৫ সালে ১ অক্টোবর খুলনার রূপসা উপজেলার ইলাইপুর মোড়ের পাশে ছোট একটি টিনের ঘর ভাড়া নিয়ে নিজ অর্থায়নে ‘অনুশীলন মজার স্কুল’ গড়ে তোলেন। প্রাথমিক অবস্থায় মাত্র ১৫ জন কর্মজীবী ও ছিন্নমূল পথশিশু নিয়ে সন্ধ্যাকালীন উপশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পাশে এসে দাঁড়ান কিছু প্রগতিশীল ব্যক্তি ও কলেজপড়ুয়া ছাত্র।

২০১৭ সালে রূপসা ঘাটে অনুশীলন মজার স্কুলের একটি নতুন শাখা স্থাপন করা হয়। ২টি শাখায় প্রায় ১৫ জন শিক্ষক পাঠদান করান, যাঁদের বেশির ভাগ বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান করেন।

কথায় কথায় নিজের কথা জানালেন অলোক, ‘ছাত্রাবস্থায় আমিও কষ্টে পড়াশোনা করেছি। নানা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করেই আজকের আমি হয়েছি।’ তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন, তাঁর হাত ধরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাবে।

অলোক বলেন, ‘সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী ও তাদের শিশুদের পুনর্বাসন ও স্থায়ী উন্নয়নই অনুশীলন মজার স্কুলের মূল লক্ষ্য, তাই ভবিষ্যতে ঝরে পড়া শিশুদের জন্য ব্যতিক্রমী কারিগরি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেখানে শিশুরা নিজেদের পড়াশোনা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে।’