ওদের জন্য অনন্য এক দিন

ওরা সবাই শিশু। বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। ওরা বেড়ে উঠেছে সমাজের এক অন্ধকার গলিতে। জীবনে স্বাদ, স্বপ্নপূরণের তেমন কিছুই নেই।

এমন জীবনের ব্যতিক্রম হলো ৫ ফেব্রুয়ারি। বদ্ধ জায়গা থেকে বেরিয়ে বেড়ানোর স্বাদ পেল। এরা হলো রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার যৌনপল্লি এবং এর আশপাশের অবহেলিত শিশু। সবাই সেদিন গিয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। এটা ছিল তাদের কাছে স্বপ্নের মতো।  দিনব্যাপী এই শিক্ষাসফরের আয়োজন করে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট থানা।    

৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে বড় একটি বাস। সঙ্গে একটি মাইক্রোবাসও। বাসভর্তি দৌলতদিয়া চাইল্ড ক্লাবের সদস্যরা।

সকাল আটটায় ৩৫ জন অবহেলিত শিশুকে নিয়ে বাস টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। দুপুর ১২টায় টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছায়। সেখানে এই শিশুরা জাতির জনকের স্মৃতি কমপ্লেক্স ঘুরে দেখে, এরপর তারা যায় শেখ রাসেল শিশুপার্কে। সেখানে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত অবস্থান করে ঘোরাফেরা শেষে দুপুরে কাচ্চি বিরিয়ানি খায়।

খাওয়ার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ দেখাতে।  সন্ধ্যায় পৌঁছে পদ্মা সেতুর অবকাঠামো দেখার পর রাত সাড়ে নয়টায় ফিরে আসে গোয়ালন্দে। এই ভ্রমণে তাদের সঙ্গে ছিলেন রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মো. শরীফুজ্জামান, মুক্তি মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম, সেভ দ্য চিলড্রেনের উপব্যবস্থাপক মোস্তফা কামালসহ অনেকে। গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডে শিশুদের    বিদায় জানান রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। তিনি প্রত্যেক শিশুকে  চকলেটও দেন।

 দৌলতদিয়ায় ফিরে আসার পর ৬ ফেব্রুয়ারি কথা হয় এই শিশুদের সঙ্গে। চাইল্ড ক্লাবের সাবেক চেয়ারম্যান ও দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, ‘৫ ফেব্রুয়ারি ছিল আমাদের জন্য এক অন্যন্য দিন।’

‘জীবনে প্রথম বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলাম’ বলল গোয়ালন্দ চাইল্ড ক্লাবের সদস্য ফকির আবদুল জব্বার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির এক ছাত্রী। সে বলে, ‘এই আনন্দে আগের দিন সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। আমার স্বপ্ন ছিল জাতির পিতার জন্মস্থান দেখার। সেই স্বপ্নপূরণ হলো।’

১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী সদস্য আছে চাইল্ড ক্লাবের। জানাল এই ক্লাবের বর্তমান চেয়ারম্যান। সে দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। মেয়েটি বলে, ‘ক্লাবের কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। আমাদের নাট্যকলা বিভাগে একদিন ওসি স্যার আড্ডা দিতে এলে তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান ঘুরে দেখার আবদার করি। তিনি আবদার পূরণে এসপি স্যারকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেন।’

মুক্তি মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম বলেন, ‘আমরা আগে ফরিদপুর পর্যন্ত বেড়াতে যেতাম। এই প্রথম অনেক দূরে বেড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে।’ 

গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান বলেন, ‘সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে চাইল্ড ক্লাবে বসি। কিছুদিন আগে তারা গান শেখার জন্য একজন শিক্ষকের কথা বললে সে ব্যবস্থা করি। এরপর ওদের অনেক দিনের স্বপ্ন জাতির পিতার জন্মস্থান ঘুরে দেখার, সঙ্গে পদ্মা সেতুও। সে জন্যই এই উদ্যোগ।’ 

পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘ওদের একটি স্বপ্ন বা শখ পূরণের চেষ্টা করেছি মাত্র। তারা সমাজে অন্য পাঁচজনের মতো মৌলিক অধিকার পাচ্ছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার।’