ভাস্কর্যের পার্ক

একাত্তর স্মরণে ভাস্কর্য। ছবি: সংগৃহীত
একাত্তর স্মরণে ভাস্কর্য। ছবি: সংগৃহীত

‘আর্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’—খানিকটা আনমনেই সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান বললেন কথাটি। তাঁর পাশে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আজিজ খান দেখছিলেন নির্মাণাধীন ভবনের দেয়ালে সদ্য বসানো একটি ভাস্কর্য—ভাষাপ্রাপ্তির আগে মানুষের ব্যবহৃত সাংকেতিক চিহ্ন।

এর আগে একের পর এক নানামাত্রিক ভাস্কর্য দেখে আমাদের চোখ ততক্ষণে মুগ্ধতা আর স্নিগ্ধতার আবেশে একাকার। তার মধ্যে আজিজ খানের কথাটি—‘আর্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ শুনে মুহূর্তেই একটু নড়ে উঠলাম। মন বলল, হ্যাঁ, তাই তো! আর্ট মানে শিল্প, ইন্ডাস্ট্রি অর্থও শিল্প। এখানে তো শিল্পের মধ্যে শিল্পকলার কায়কারবারই হচ্ছে। তাই এখানকার বাস্তবতায় এর চেয়ে যথার্থ কথা আর কী হতে পারে!

গল্পের শুরু
শুরুটা হয়েছিল গাজীপুরের কড্ডায় সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ‘হামিদুজ্জামান খান স্কাল্পচার পার্ক’ দর্শনের মধ্য দিয়ে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে ভাস্কর্য পার্ক! বিষয়টি কেমন হয়ে গেল না? প্রথম দিকে একটু খচখচ করছিল মন। তবে খচখচানির সবটুকু মুহূর্তেই নেই হয়ে গেল গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার কড্ডায় সামিট পাওয়ারের ৪৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অবস্থিত ভাস্কর্য পার্কে দাঁড়িয়ে।

গত ৩১ জানুয়ারি সকালে আমরা যখন এই পার্কে পা রাখলাম, আমাদের মন চনমনে করে দিতে মাঘী শীতের রোদের সায় ছিল বৈকি। মনটা আরেক প্রস্থ উজ্জ্বল হয়ে উঠল পার্কের প্রবেশমুখে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দালানের গায়ে ৩৪০ ফুট ম্যুরাল দেখে। সাদা পটভূমির ওপর পাথর ও ধাতু দিয়ে তৈরি ম্যুরালটি দেখে এক পলকে বোঝা যায়, শ্রম ও সৃষ্টির জয়গানই শোভা পাচ্ছে জ্যামিতিক নানা আকার দিয়ে গড়া এ ম্যুরালের অঙ্গে-উপাঙ্গে।

 ‘এর সঙ্গে কি বিদ্যুতের সম্পর্ক নেই’—ম্যুরালের স্রষ্টা হামিদুজ্জামান খানের প্রশ্নটি শুনে পেছন ফিরে তাকাতেই হলো।

‘বিদ্যুৎ আমাদের সভ্যতাকে গতিশীল করেছে। এ ম্যুরালের মধ্য দিয়ে আমি সেটি ধরার চেষ্টা করেছি। ম্যুরালের ওই গোল চাকতিগুলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী টারবাইনের সঙ্গেও তুলনা করার সুযোগ আছে। এটি কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ম্যুরাল।’—নিজের প্রশ্নে নিজেই উত্তর দিতে দিতে এবং আমাদের অজস্র সওয়ালের জবাব বাতলাতে বাতলাতে তাঁর একেকটি সৃষ্টির সামনে সবাইকে নিয়ে যাচ্ছিলেন হামিদুজ্জামান খান।

ভাস্কর্য পার্কে হামিদুজ্জামান খান ও মুহাম্মদ আজিজ খান
ভাস্কর্য পার্কে হামিদুজ্জামান খান ও মুহাম্মদ আজিজ খান

হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক
২০১৮ সাল থেকে উৎপাদনে যাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভেতরে পার্ক গড়ার কাজ শুরু হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার অব্যবহিত পরেই। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। ৩৬ একর জায়গার বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে পার্কটি দুই একরজুড়ে। ম্যুরাল ছাড়া এখানে ভাস্কর্য রয়েছে ২০টির ওপরে। একটি পাখির ভাস্কর্যে চোখ আটকাল ঘুরতে ঘুরতে। পাথর ও ধাতুতে গড়া ভাস্কর্যটি যেন অবিরতভাবে বলে চলেছে মুক্তি ও শান্তির কথা। অন্য ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে আছে ল্যাম্পপোস্টের নিচে পড়াশোনারত একজন মানুষ, আছে অপেক্ষারত এক মায়ের প্রতিকৃতি।

একাত্তর স্মরণে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া গেল পার্কটিতে। ২৫ মার্চের গণহত্যার আইকনিক আলোকচিত্র—এক রিকশাচালক ও যাত্রীকে হত্যা করে গেছে হায়েনারা—আলোচিত ওই ছবির ভাস্কর্যরূপ পাওয়া গেল এখানে। পাওয়া গেল ‘সংশপ্তক-৩’ নামে যুদ্ধদিনের আরেকটি ভাস্কর্যও। তবে কোনো ভাস্কর্যেরই এখনো নাম দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ ভাস্কর্যই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধাতু দিয়ে। হামিদুজ্জামান বললেন, ‘পার্কটির কাজ এখনো চলমান। আরও কিছু করা হবে। তারপর ভাস্কর্যগুলোর নামকরণ করা হবে।’

ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, একাধিক তলাবিশিষ্ট নতুন একটি দালানের নির্মাণকাজ চলছে। দালানটিতে থাকবে হামিদুজ্জামান খানের আঁকা ছবি আর বেশ কিছু ভাস্কর্য। সব মিলিয়ে হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্য পার্কটি ঘিরে এখন যে এলাহি কর্মযজ্ঞ চলছে, বোধ করি তা আর না লিখলেও বোঝা যাবে।

সংশপ্তক–৩ নামের যুদ্ধদিনের ভাস্কর্য
সংশপ্তক–৩ নামের যুদ্ধদিনের ভাস্কর্য

পেছনের কথা
হামিদুজ্জামান খানের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল একটি ভাস্কর্য পার্ক গড়ার। এ জন্য কাশিমপুরে এক একর জায়গাও কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু এতটুকু পরিসরে তাঁর একার পক্ষে ভাস্কর্য পার্ক তৈরি খানিকটা দুরূহই ছিল। এর মধ্যে আজিজ খানের কাছ থেকে এল উষ্ণ আমন্ত্রণ। উপরন্তু, পার্কের নামকরণও তিনি করলেন হামিদুজ্জামান খানের নামে।

‘একজন ভাস্কর বা শিল্পীর জন্য এটা অনেক বড় সম্মানের না?’ হামিদুজ্জামান খানকে জিজ্ঞেস করতেই বেশ উচ্চ স্বরে তাঁর মুখ দিয়ে বের হলো একটিমাত্র শব্দ, ‘অবশ্যই’। চার অক্ষরের ওই শব্দ দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করার মধ্য দিয়েই যেন বুঝিয়ে দিলেন, শিল্পী হিসেবে কতটা সম্মানিত হয়েছেন তিনি।

কিন্তু আজিজ খান, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ভাস্কর্য পার্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাটি কেমন ছিল?

‘আমরা অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করছি। এখন মানসিক উৎকর্ষ সাধন করা খুব বেশি দরকার। এটা করতে গেলে আমাদের শিল্পকলার সান্নিধ্যে আসতে হবে। ভাস্কর্য পার্ক করার ভাবনাটা এসেছে এখান থেকেই।’

ল্যাম্পপোস্টের আলোয়
ল্যাম্পপোস্টের আলোয়

পার্ক তৈরির নেপথ্য-ভাবনার কথা আজিজ খানের মুখ থেকে শুনতে শুনতে তাঁর সম্পর্কে আরেকটু উৎসাহ জাগল আমাদের। জানতাম, তিনি শিল্পকর্ম–সংগ্রাহক। বাংলাদেশের কালজয়ী শিল্পীদের চিত্রকলা আছে তাঁর সংগ্রহে। শিল্পকলার প্রতি এই ভালোবাসা তাঁর কীভাবে জন্মাল? না, প্রশ্নটি আজিজ খানকে করার ফুরসত পাইনি, এর আগেই ভাস্কর্য পার্কের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শিল্পকলার প্রতি ভালোবাসার কথা বলতে বলতে একান্ত ব্যক্তিগত একটি তথ্য আমাদের সামনে উপুড় করলেন এই ব্যবসায়ী, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে কাছ থেকে দেখা। ১৯৬৯ সালে আমি ছিলাম নটর ডেম কলেজের ছাত্র। জয়নুল আবেদিনের ছেলে মঈনুল আবেদিন ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। সেই সূত্রে শান্তিনগরে ওদের বাসায় যেতাম, জয়নুল আবেদিনকে চাচা বলে ডাকতাম। তখন তাঁকে তুলি-ক্যানভাস নিয়ে বসে থাকতে দেখেছি, ছবি আঁকতে দেখেছি। শিল্পকলার প্রতি ভালোবাসাটা এভাবেই তৈরি হয়েছে আমার।’

সেই ভালোবাসা থেকেই সামিটের অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও ক্রমান্বয়ে ভাস্কর্য পার্ক তৈরি করতে চান আজিজ খান; এবং দায়িত্বটি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন হামিদুজ্জামান খানের হাতেই। 

আমরা ফিরে আসছিলাম। এ সময় হঠাৎ দেখলাম, বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক তরুণ প্রকৌশলী ধাতু ও পাথরে গড়া পাখির ভাস্কর্যের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে কী যে এক আশ্চর্য শান্তির আলপনা খেলা করছে! সামিট গাজীপুর ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রবল গতিময়তার মধ্যে হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে বোধ হয় ওই শান্তির পরশ পাওয়ার বাসনাতেই।