শরিফুল অভাবের সংসারে কিছুই পাননি

১৩ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ে পরিবারের সঙ্গে শরিফুল ইসলাম।  ছবি: ছুটির দিনে
১৩ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ে পরিবারের সঙ্গে শরিফুল ইসলাম। ছবি: ছুটির দিনে

বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলামের জীবনেরই একটি অংশ যেন কবি নজরুলের অমর পঙ্‌ক্তিখানায় ফুটে উঠেছে, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।/ তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান/ কণ্টক-মুকুট শোভা...’।

শরিফুলদের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দণ্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারী গ্রামে। বাবা দুলাল ইসলাম ভূমিহীন কৃষক। মা বুলবুলি বেগম গৃহিণী। ১৯ শতক জমি, সেখানেই বাড়ি, সেখানেই তাঁদের আশ্রয়। একটা সময় অভাবের সংসারে সপ্তাহের দু-তিন দিনও না খেয়ে থাকতে হতো শরিফুলদের। খাবার আর কাজের সন্ধানে পরিবার নিয়ে ঢাকার সাভারে পাড়ি জমিয়েছিলেন দুলাল ইসলাম। সেটা ২০০১ সালের কথা। সাভারে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন তিনি। সাভারের একটি স্কুলে শরিফুলের পড়াশোনা শুরু হয়। 

২০১০ সালে আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে আবারও গ্রামের বাড়িতে চলে আসে শরিফুলের পরিবার। বাড়ির কাছের কালীগঞ্জ এসপি উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয় শরিফুলকে। শরিফুল স্কুল ফাঁকি দিয়ে তখন ক্রিকেট খেলতে যেতেন। নিজের ব্যাট-বল কেনার সামর্থ্য না থাকায় খেলতেন বন্ধুদের ব্যাট-বল দিয়ে।

এরই মধ্যে শরিফুলের বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম চলে যান ঢাকায়। কাজ নেন তৈরি পোশাক কারখানায়। এদিকে ক্রিকেট পেয়ে বসে শরিফুলকে। না খেয়ে খেলতে গিয়ে প্রায়ই বেশ হাঁপিয়ে উঠতেন শরিফুল। তখন বড় ভাইকে লুকিয়ে ফোন করতেন শরিফুল; বলতেন না খেয়ে থাকার কথা। ভাইয়ের কাছে টাকা চাইতেন। চেয়েচিন্তে আশরাফুল মাঝেমধ্যে ২০০ কি ৩০০ টাকা পাঠাতেন।

একসময় নিজের ছোট ভাইয়ের খেলার আগ্রহ ছুঁয়ে যায় আশরাফুলকেও। তিনি শরিফুলকে ক্রিকেটার বানাতে পাশে দাঁড়ান। সে কারণেই ২০১৬ সালে দিনাজপুরের ক্লেমন একাডেমিতে সাত দিনের একটি ক্রিকেট অনুশীলন কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন শরিফুলের মা–বাবা। অনুশীলনে যোগ দিতে যাওয়ার সময় শরিফুলের প্রথম গেম সেটের ব্যাটটি কিনে দেন সাভারে আশরাফুলের ভাড়া বাড়ির মালিক।

সাত দিনের ওই অনুশীলন কোর্সের তৃতীয় দিনের মাথায় শরিফুলের বল করা দেখে ওই টিমে থাকা জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ধীমান ঘোষ তাঁকে পছন্দ করে ফেলেন। এরপর সাবেক ক্রিকেটার আলমগীর কবীর ও হান্নান সরকারের সহায়তায় শরিফুলের সুযোগ হয় রাজশাহীতে অনুশীলন ক্লাবে কোর্স করতে যাওয়ার।

আশরাফুল ইসলাম ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন শরিফুলকে। এসএসসি পাস করে তাতেই পড়াশোনা আর খেলা চালিয়ে নিতেন শরিফুল। পরে ঢাকায় থার্ড ডিভিশনে খেলার সুযোগ পান। সেখানও চমক দেখান। এরপর ২০১৭ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে খেলার সুযোগ পান শরিফুল। ২০১৮ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) এবং ২০১৯ সালে খুলনা টাইটানের হয়ে বিপিএলে খেলেন তিনি। এ সময়ই ডাক পড়ে অনূর্ধ্ব-১৯ খেলায়। 

২০১৮ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের খেলায় যে উপার্জন হয়, তা দিয়ে একটি টিনশেড পাকা বাড়ি করেছেন বাবার ভিটাতে। সেখানেই করেছেন একটি গরুর খামার। বড় ভাইও পোশাক কারখানার কাজটি ছেড়ে এসেছেন বাড়িতে। বাবার সঙ্গে সেই গরুর খামারই দেখাশোনা করেন তিনি। প্রতিদিন যে দুধ হয়, তা বিক্রি করেই এখন চলে তাঁদের সংসার আর ছোট দুই বোনের লেখাপড়ার খরচ। 

শরিফুলের বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম দুঃসহ কষ্টের দিনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বলে গেলেন, ‘আমার ভাই অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় গেছে। অভাবের সংসারে তাকে কিছুই দিতে পারিনি। পুরোপুরি সমর্থন দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না আমাদের।’