মায়ের 'আশকারায়' স্বপ্নপূরণ

নিজেদের বাড়িতে মা ও বাবার সঙ্গে পারভেজ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
নিজেদের বাড়িতে মা ও বাবার সঙ্গে পারভেজ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

পারভেজের বয়স তখন চার কি পাঁচ। সুযোগ পেলে ব্যাট আর টেপ মোড়ানো টেনিস বল নিয়ে নেমে পড়ত গলির রাস্তায়। সঙ্গী দু-একজন মিলে শুরু হতো ব্যাটিং। কিন্তু এতেই বিপত্তি। বল পড়ে ভাঙছে কারও জানালার কাচ, কিংবা কারও ফুলের টব। প্রতিদিন এ রকম নালিশ আসতে থাকল মায়ের কাছে। পারভেজও নাছোড়, খেলা চলবেই। মা ছেলের খেলায় বাধা হতে চান না। শেষমেশ উপায় বের করলেন মা—ভর্তি করিয়ে দিলেন ক্রিকেট একাডেমিতে। সেই শুরু। গলির রাস্তা ছেড়ে সখ্য গড়ে উঠল মাঠের ২২ গজের সঙ্গে।

অনূর্ধ্ব–১৯ দলের বিশ্বকাপজয়ী দলের লড়াকু ওপেনার পারভেজ হোসেনের ক্রিকেটজীবন শুরুর গল্পটা এ রকম। ছেলের ক্রিকেটপ্রীতিকে বরাবরই ‘আশকারা’ দিয়েছেন গৃহিণী মা কুসুম আকতার। পারভেজদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ভবানী জীবনপুর গ্রামে। বাবা সিরাজ বাবুলের কাপড়ের ব্যবসার সূত্র ধরে বসবাস চট্টগ্রাম নগরের খলিফাপট্টিতে। সেই ভাড়া বাড়িতেই পারভেজের জন্ম, বেড়ে ওঠা। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে সবার ছোট। তাই আদরেরও।

মা-বাবার কাছে অন্য শিশুদের বায়না যখন খেলনা কিংবা চকলেট, তখন পারভেজের একটাই চাওয়া—ক্রিকেটের ব্যাট আর বল। ঘর ভর্তি ছিল ব্যাট-বলে। কখনো মা,
কখনো বাবা, না হয় বড় ভাই ফয়সাল হোসেন নিয়ে আসতেন তার জন্য।

পারভেজের ক্রিকেটের হাতেখড়ি ইস্পাহানি ক্রিকেট একাডেমিতে কোচ নুরুল আবেদীন নোবেলের কাছে। একাডেমিতে আসা-যাওয়ার ফাঁকে একদিন শুনলেন চট্টগ্রামে বিকেএসপির (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ হবে। তখন তিনি শাহ ওয়ালী উল্লাহ ইনস্টিটিউটের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন। বাসায় মাকে জানিয়ে বলেন, ‘আমি যাবই যাব’। ছেলের চোখ দেখেই মা বোঝেন তাঁকে ঠেকানো কষ্টকর। বাবাকে না জানিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাগরিকার মাঠে পাঠিয়ে দেন। প্রথম ধাপেই ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হন।

কিন্তু বাদ সাধেন বাবা। বললেন, ‘আমার এইটুকুন ছেলে এক মাস বাইরে থাকবে। তার ওপর খেলবে কাঠের বলে। না, হবে না।’ এই যাত্রায় আবার মায়ের আশ্রয়। মা সঙ্গে নেন বড় ভাই ফয়সালকে। দুজন মিলে বাবাকে বোঝান। অবশেষে সায় মেলে।

এরপর আরও নানা ধাপ পেরিয়ে ২০১৩ সালে ভর্তির সুযোগ হয় বিকেএসপিতে। সেখানেও ঝামেলায় পড়েন পারভেজ। কারণ, তাঁর উচ্চতা কম। ভর্তির জন্য দরকার ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। কিন্তু পারভেজের উচ্চতা তখন ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি। এবার আগলে নেন কোচ সালাউদ্দিন। তিনি ক্যাম্পে পারভেজের খেলা দেখেছিলেন।

পারভেজ বলেন, ‘ট্রায়ালের সময় এক ওভার বল করা হয় আমাকে। এই এক ওভারেই চারটি ছক্কা মেরেছিলাম। এরপর আর ভর্তি আটকায়নি।’ বিকেএসপিতে ভর্তি হন ক্লাস সেভেনে।

ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে মায়ের পাশ ছেড়ে এক কিশোরের আলাদা হয়ে পড়া। তখনো মা ভেতরে দুমড়েমুচড়ে গেলেও ছেলেকে দেখাননি হৃদয়ের সেই ভাঙন। বুকে পাথর চেপে ছেলের স্বপ্নপূরণে তাঁকে সাহস দেন।

পারভেজ বলেন, ‘বাড়ি ছেড়ে আসার পর প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগত। মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হতো। মাঝেমধ্যে খুব কান্না পেত। অবশ্য নিজেকে সামলে নিতাম।’

সামলে নিয়েছেন বলেই তো দেশকে জেতানোর চাপটাও ঠান্ডা মাথায় সামলে নিতে পারেন পারভেজ।