বিয়ের আয়োজন নিয়ে শঙ্কায় আছি

আমরা দুই ভাই শ্রমজীবী মানুষ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসজীবন আমাদের। একই দেশে থাকলেও দুটি ভিন্ন শহরে বসবাস আমাদের। পরিবার-পরিজন ছেড়ে জীবিকার তাগিদে দূরদেশে থাকি, প্রতিদিনই মনে হয় দেশে ফিরে আসি, কিন্তু চাইলেই তো আর আসা যায় না। দীর্ঘদিন পর ৬ মার্চ আমরা একসঙ্গে দেশে এসেছি। এবার আসার অবশ্য উপলক্ষ আছে। আমার ছোট ভাইকে বিয়ে করানো। দুবাইয়ে থাকতেই পরিবারের মাধ্যমে বিয়ের সমস্ত আয়োজন করা হয়েছিল। ২৭ মার্চ ছিল বিয়ের দিন। তবে দেশে এসে মুখোমুখি হলাম করোনাভাইরাস–আতঙ্কের। অন্য রকম অভিজ্ঞতা দুই ভাইসহ আমাদের পুরো পরিবারেরই। 

মানিকগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে এসেই গৃহবন্দী (কোয়ারেন্টিন) হয়ে পড়ি আমরা। প্রায় দুই সপ্তাহ পর, ১৭ মার্চ থেকে সেই বন্দিদশা থেকে যেন মুক্তি পেলাম। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে জানানো হয়েছিল, করোনাভাইরাসের আশঙ্কা নেই। আমরাও খুশি মনে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু বাড়িতে আসার পরদিনই সকালে একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসে হাজির হলেন। অনেক করে বলে গেলেন, বাড়ি থেকে যেন আমরা বের না হই। ঘরে একটি কক্ষে থাকতে বললেন। যেকোনো মানুষের সঙ্গে অন্তত ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলতে বললেন, আরও কিছু নির্দেশনা। 

চিন্তা করলাম, স্বাস্থ্যকর্মী তো মন্দ বলেননি। পত্রিকা, টেলিভিশনের খবরেও এমন নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে বলা হচ্ছে। ভয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম—যদি করোনাভাইরাস আমরা সত্যিই বয়ে এনে থাকি, তা যদি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছড়ায়। তাই দুই ভাই দুই ঘরে নির্দেশনা অনুযায়ী থাকতে শুরু করলাম। প্রায় প্রতিদিন চিকিৎসক এসে স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন। 

দিনে দিনে এ এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হলো। দীর্ঘ তিন-চার বছর পর পরিবারের কাছের মানুষদের কাছে এসেছি। একটিই ছোট সন্তান। স্ত্রী ও মা–বাবা রয়েছেন। এত দিন পর বাড়িতে এসে শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারছিলাম না। পরিবারের সবার থেকে দূরে থাকা এ যে কী কষ্টের, তা বোঝানো যাবে না। আলাদা বিছানায় থাকা, আলাদা খাওয়াদাওয়া—এ এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। 

এই কয়টা দিন প্রায় সারাক্ষণ টেলিভিশন দেখে ও ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। মাঝেমধ্যে বাড়ির উঠান পর্যন্ত গিয়েছি। ভালোমন্দ খেয়েছি। তাতে কী! স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে মিশতে না পেরে পোলাও-মাংস খেতে কে চাইবে? 

আমরা জানতাম, এই ভাইরাস ছোঁয়াচে। ভয়ে ছিলাম যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকি, তা তো আমার আদরের সন্তান, স্ত্রী ও মা–বাবার মধ্যে ছড়াতে পারে। তাই কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে নিয়ম মেনে চলেছি। ১৭ মার্চ থেকে সবার সঙ্গে মিশতে পারছি, কী যে আনন্দ লাগছে, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। 

তবে এখন একটি বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি। সেটা ভাইয়ের বিয়ে, যে জন্য দেশে আসা। বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হলেও যে পরিস্থিতি শুনছি ও দেখছি, তাতে ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আমরা। ভাইয়ের ইচ্ছে ছিল বিয়েতে বড় আয়োজন, আত্মীয়স্বজন ও অতিথিদের ঘটা করে দাওয়াত করার। তবে এখন মনে হচ্ছে সেটা আর সম্ভব নয়। দুই পক্ষের কয়েকজনকে নিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে হবে। কিন্তু কোয়ারেন্টিনে ছিলাম বলে সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। জানি না কী হবে। 

যা–ই হোক, আগে সুস্থ থাকাটা জরুরি। সতর্ক ও সচেতন থেকেই আমাদের সব কাজ করতে হবে। আমি ভালো থাকলে, পরিবারও ভালো থাকবে। আমার ছোট্ট শিশুটিও থাকবে নিরাপদ। সবাই নিরাপদে থাকুন। 

১৮ মার্চ ২০২০
অনুলিখিত