করোনায় প্রাণীদের জন্য ভালোবাসা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের প্রাণীদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন প্রাণীপ্রেমী কিছু মানুষ। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের প্রাণীদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন প্রাণীপ্রেমী কিছু মানুষ। ছবি: সংগৃহীত

২০ মার্চ। আর দশটা দিনের মতোই সন্ধ্যা নামছে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক, হল ছাড়তে শুরু করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ করোনাভাইরাস মোকাবিলার অংশ হিসেবে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।

শহীদুল্লাহ্‌ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ইসতিয়াক আহমেদও তল্পিতল্পা গুটিয়ে বের হচ্ছিলেন কক্ষ থেকে। এমন সময় একটি বিড়াল এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। বিড়ালটি নিয়ম করে আসে প্রতিদিনই। কোনো দিন একা, কোনো দিন সঙ্গীসহ। ওরা এলে ইসতিয়াক কিংবা রুমের অন্য বন্ধুরা এটা-ওটা খেতে দেন।

সেদিনও একা এসেছিল। কক্ষ তালাবদ্ধ করার সময় পায়ে-পায়ে ঘুরতে থাকে। বিড়ালটির দিকে তাকিয়ে ইসতিয়াকের কেমন একটা লাগে। ওর অসহায়ত্ব নাড়া দেয় তাঁকে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাস জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে। সবাই চলে যাচ্ছে নিরাপদ গন্তব্যে। কিন্তু ক্যাম্পাসে থাকা এই প্রাণীরা! করোনায় সতর্কতা অবলম্বনের ব্যাপার নেই ওদের। নেই নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়াও। এই ক্যাম্পাস, আবাসিক হল, টিএসসি, খেলার মাঠ, ফুলার রোড, মল চত্বর—এসবই তো এই অবলা বিড়াল-কুকুরগুলোর আবাসস্থল। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী বন্ধুরাই ওদের নিরাপদ খাদ্য জোগানের একমাত্র উৎস। তাহলে শিক্ষার্থীবিহীন ক্যাম্পাসে কীভাবে হবে ওদের খাদ্যের জোগান? ভাবনাটি মাথায় নিয়েই হল ছাড়েন ইসতিয়াক।

সেদিন রাতে বন্ধুর বাসায় ওঠেন। আক্ষরিক অর্থেই নির্ঘুম কাটতে থাকে রাতের প্রহরগুলো। অনেক ভেবেচিন্তে রাত আড়াইটার দিকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ গ্রুপে একটি পোস্ট দেন। মুহূর্তের মধ্যে মন্তব্যের ঘরগুলো ভরে উঠতে থাকে শিক্ষার্থীদের উৎসাহমূলক এবং আবেগঘন মন্তব্যে। ঢাকায় থেকে যাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। যাঁদের পক্ষে সশরীরে উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়, আন্তরিক শুভকামনা জানান তাঁরা। এই অভূতপূর্ব সাড়া এবং পশুর প্রতি অগণন মানুষের এই নির্মল ভালোবাসা দেখে ইসতিয়াকও আশাবাদী হয়ে ওঠেন। অনুভব করেন মানবিক দায়বদ্ধতা। কুকুর-বিড়ালগুলোর খাবারের জোগানের জন্য গ্রামের বাড়ি না গিয়ে, শহরেই থাকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটাকে যথার্থই মনে হয়।

মাহাবুব হাসান, সাবরিনা, ঐশী, মো. বায়েজিদ, ফারজানা, রফিক আহমেদসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ইসতিয়াকের পাশে এসে দাঁড়ান। ২১ মার্চ সকালেই নিজেদের টাকায় কেনা খাবার নিয়ে যথারীতি উপস্থিত হয় ক্যাম্পাসে। বিড়ালের জন্য বিস্কুট, টোস্ট; কুকুরের জন্য চানখাঁরপুলের হোটেল থেকে খিচুড়ি, তেহারি কিনে আনেন। হোটেলগুলো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন মাছের কাঁটা, উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়। নিজস্ব মোটরসাইকেল থাকায় বেশ সুবিধা হয়েছে। খাবার নিয়ে মুহূর্তেই টিএসসি থেকে ফুলার রোড, শহীদুল্লাহ্‌ হল থেকে কবি জসীমউদ্‌দীন হলের মাঠ। মাস্ক পরে, স্যানিটাইজার সঙ্গে নিয়ে যথাযথ আত্মসুরক্ষা নিশ্চিত করেই কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা।

ইসতিয়াক বলেন, ‘একটি মা কুকুরকে দেখলাম, একেবারে রুগ্‌ণ। অভুক্ত পেট চিমসে মেরে আছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বুকের হাড়গুলো। তিনটা বাচ্চা নিয়ে অসহায়ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক। আমরা চানখাঁরপুল থেকে খিচুড়ি কিনে এনে খেতে দিলাম। তিন সন্তানসহ মা কুকুরটি খেলো। মনে হলো, আরও খেতে চায়। আবার গিয়ে কিনে আনলাম। হোটেলের উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়গুলোও নিয়ে এলাম পলিথিনে করে। সব খেয়ে নিল চেটেপুটে। ওদের খাওয়া দেখতে দেখতে আমার চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো অবস্থা।’

তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছে ইসতিয়াক আহমেদ। বন্ধুমহলে পরিচিত হৃদয় নামেই। শুধু নামের অংশ হিসেবেই নন, হৃদয় নামটিকে যেন হৃদয় দিয়েই বহন করছে হৃদয়বান ছেলেটি।