সুনসান শিবচর

প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না শিবচরের মানুষ। ছবি: ছুটির দিনে
প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না শিবচরের মানুষ। ছবি: ছুটির দিনে

২৫ মার্চ এসে মনে পড়ছে ঠিক পাঁচ দিন আগের ঘটনা।

সকাল থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করব। জেনেছি, চট্টগ্রাম থেকে এসেছে এনামুল, ঢাকা থেকে এসেছে মোস্তাফিজ ও রবিন। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে একসঙ্গে হওয়া হয়নি অনেক দিন। তা আর হলো না। দুপুরে এনামুলই খুদে বার্তা পাঠাল, ‘বন্ধু, আসিস না। আমার চাচা-চাচির করোনাপজিটিভ। সাবধানে থাক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য দোয়া কর।’

ওই দিন সন্ধ্যাতেই ঘোষণা এল শিবচর—লকডাউন, মানে অবরুদ্ধ। দিন কয়েক ধরে ‘লকডাউন’ শব্দটির সঙ্গে মানুষ পরিচিত হলেও নিজেদের ওপর যখন শব্দের প্রয়োগ হলো, তখন যেন সত্যিকার অর্থটা বুঝতে পারলাম। দেশের প্রথম অবরুদ্ধ এলাকার খেতাবও জুটল মাদারীপুরের শিবচরের মানুষের ভাগ্যে! ঘোষণার পরই সাধারণ জনগণের মধ্যে নেমে এল এক অজানা আতঙ্কের ছায়া। শিবচরজুড়ে যেন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। কারণ, এমন পরিবেশের সঙ্গে এলাকার মানুষের পরিচয় নেই।

আমার কথাই বলি। শিবচর উপজেলার একটি গ্রামে আমার বাড়ি। এই তো কয়েক দিন আগেও ভোরে উঠে বাজার করতে গিয়ে দেখেছি কত মানুষের সমাগম। ভোরের বাজার যেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আড্ডা দেওয়ার একটি মোক্ষম জায়গা। সেই আড্ডায় থাকত সাম্প্রতিক বা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা। আমিও উপভোগ করতাম খুব।

বেলা গড়িয়ে দুপুরের পর পড়ন্ত বিকেলে সবাই কাজ সেরে মাঠে এসে পড়ত। সব বয়সের মানুষ মিলে কী মজা করেই না ক্রিকেট খেলেছি। সন্ধ্যার পর এলাকার নির্দিষ্ট চায়ের দোকান ছিল মূল মিলনমেলা। প্রতি সন্ধ্যায় বয়স্ক থেকে ছোট—সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতাম। কী চমৎকার সময়ই না আমরা কাটাচ্ছিলাম।

এখন চায়ের দোকান বন্ধ। পাশের মুদিদোকানটাও আধখোলা। কোনো জনসমাগম তো দূরে থাক, প্রয়োজনের বাইরে কেউ দাঁড়ায় না। বিকেলে কেউ মাঠে যায় না। সারা দিন বাড়ির সামনের রাস্তাটায় এখন নিস্তব্ধতা, যে পথ সারা দিন ছিল পথচলতি মানুষ আর যানবাহনে ব্যস্ত।

আমাদের শিবচর উপজেলা সারা দেশের মধ্যে অন্যতম প্রবাসীবহুল এলাকা। বলতে গেলে অর্ধেকের বেশি পরিবারের কেউ না কেউ বিদেশে থাকেন। এই প্রবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত এবং উপার্জনের জন্যই মূলত বিদেশে গিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের আতঙ্কের পর প্রবাসীদের অনেকেই হঠাৎ করেই দেশে ফিরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে বিদেশ থেকে বা যাত্রাপথে তাঁরা যেই অবস্থায় আসুন না কেন, সরকারের নির্দেশনামতে হোম কোয়ারেন্টিন করতে বললেও তাঁদের অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতার মাশুল এখন আমাদের বন্দিদশা।

আমি কোনো যুদ্ধ দেখিনি, তবু যুদ্ধদিনের সময়ের বিভীষিকার কথা এখন কেন যেন মনে হয়। আমাদের বর্তমান অবস্থা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে সেই পরিস্থিতি। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে অনেক বন্ধুবান্ধব-শুভাকাঙ্ক্ষী ফোন করে এমনভাবে খোঁজ নিচ্ছেন, যেন দুর্গত কোনো এলাকায় আছি।

জানি না এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে আমাদের পরিত্রাণের উপায় কী। তবু, আমি ঘরে থাকছি, আশপাশের প্রবাসীদের ঘরে থাকার অনুরোধ করছি। একদিন নিশ্চয় সুদিন আসবে।