আছি করোনা-আক্রান্তদের সেবায়

অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন  সুরাইয়া আক্তার
অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন সুরাইয়া আক্তার

আমার কর্মস্থল অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের হার্সটন শহরের মেট্রো নর্থ হসপিটাল অ্যান্ড হেলথ সার্ভিস। এক বছর হলো এই হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছি। ৩৫০ শয্যার হাসপাতালটির একটি অংশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দেওয়া হচ্ছে কিছুদিন হলো। তিনজন চিকিৎসক এবং একদল নার্সের মাধ্যমে এখন ৯ জন করোনা পজিটিভ মানুষ আমাদের এখানে সেবা নিচ্ছেন। ২৩ মার্চ থেকে চিকিৎসকদের একজন হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি।

যেদিন হাসপাতাল প্রশাসন থেকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, বুঝিয়ে দেওয়া হলো কাজ সম্পর্কে, অস্বীকার করব না—সব জেনে শুরুতে কিছুটা ভয়ই হচ্ছিল। কিছুদিন ধরেই তো ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি আমরা। সংবাদমাধ্যম, ইন্টারনেট, সামাজিকযোগাযোগমাধ্যম—কোথাও তো করোনার বাইরে কোনো কথা নেই। দেশে দেশে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর খবর, চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক-নার্সদের আক্রান্ত হওয়ার খবর,  চিকিৎসকদের করুণ পরিণতির কথা—এসবই আলোচনার বিষয়, খবরের বিষয়। তাই শুরুতে দায়িত্ব পেয়ে সেই শঙ্কা ভর করছিল আমার ভেতর। আমি আক্রান্ত হলে বাসায় আমার মেয়ে আক্রান্ত হতে পারে, ছড়াতে পারে স্বামীর শরীরে। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে মানুষের প্রতি নিজের কাজের দায়বদ্ধতার কথা সেই মুহূর্তেই সাহস জোগাল, মনের ভেতর গুমরে ওঠা আতঙ্কের কালো মেঘ সরিয়ে আমিও কাঁধে নিলাম দায়িত্ব। সেদিন থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরে সেবা দিচ্ছি আক্রান্ত মানুষদের।

এই হাসপাতালে আক্রান্ত মানুষদের অনেকে প্রমোদতরি রুবি প্রিন্সেসের যাত্রী ছিলেন। তাঁদের ৯ জনের মধ্যে ৬ জন স্বামী-স্ত্রী। আবার একজন ছাড়া সবার বয়স ষাটোর্ধ্ব। বয়স বেশি বলে ঝুঁকিও বেশি। তার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন অনেকে, আছে অ্যালার্জির সমস্যাও। দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্য একটি কক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখি, তদারক করি। প্রয়োজন হলে যেতে হয় কক্ষে।

সেবা দিতে গিয়ে পদে পদে নানা অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আগে কখনো হইনি। যাঁদের জন্য যেসব চিকিৎসাযন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তা শুধু এই রোগীদের জন্যই ব্যবহার করতে হয়, নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করে নিতে হয়।

সংগত কারণে আক্রান্তদের সঙ্গে সহজভাবে মেশা যাচ্ছে না, এই আচরণও তাঁদের কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু যতটা সম্ভব সাহস জোগানোর চেষ্টা করি। সব মিলিয়ে আক্রান্ত মানুষেরা কী যে এক ভীতিকর সময় পার করছেন, তা তাঁদের কাছে না গেলে বুঝতাম না।

আমার বাসা থেকে হাসপাতালের দূরত্ব ৪০ মিনিটের পথ। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর আগেই এক দফা জীবাণুমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। বাসায় ঢুকেই কাপড়চোপড় পরিষ্কার করে গোসল সেরে নিই। তবু মনে হয় ভাইরাস সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি। হয়তো আমার থেকে অন্য কেউ আক্রান্ত হবে। এসব শঙ্কার মধ্যেও মনে করি, চিকিৎসক হিসেবে এমন সংকটের সময় কাজ করতে পারা নিঃসন্দেহে আমার জন্য বড় সুযোগ।