থমকে যাওয়া শহরে প্রাণের স্পন্দন

ঘরবন্দী জীবন কাটিয়ে কাজে বেরিয়েছেন শিয়ান শহরের মানুষ। ছবি: সংগৃহীত
ঘরবন্দী জীবন কাটিয়ে কাজে বেরিয়েছেন শিয়ান শহরের মানুষ। ছবি: সংগৃহীত

অনেক দিন পর আবার মানুষের মুখে হাসি দেখছি, বাইরে বেরিয়ে খোলা আকাশ দেখছি। বসন্তের আগমন যেন থমকে গিয়েছিল দীর্ঘ দুই মাস গৃহবন্দী জীবনে, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা জীবন যেন ধূসর হয়েছিল এক অন্ধকার সময়ে। কিন্তু বসন্তের ফুল ফোটার মতোই চীনের বুকে আবারও নতুন করে জেগে উঠেছে প্রাণের স্পন্দন, প্রকৃতির সৌন্দর্য আর নতুন প্রেরণায় ফিরে এসেছে জীবনের আলো।

এ দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব চীনা নববর্ষ ও বসন্ত উৎসব। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়ে জমকালো এ উৎসব চলে এক মাস ধরে। আমি থাকি শানসি প্রদেশের শিয়ান শহরে, যেখানে চীনের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ নববর্ষ ও বসন্ত উৎসব পালিত হয়। চীনাদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘যদি ৫০ বছরের চীনকে জানতে চাও, তবে সাংহাই যাও; যদি ৫০০ বছরের চীনকে জানতে চাও, তবে বেইজিং যাও; আর যদি ৫ হাজার বছরের চীনকে দেখতে চাও, তবে শিয়ান যাও’। শিয়ান চীনের প্রথম রাজধানী ও ঐতিহাসিক শহর। এখান থেকেই শুরু গুরুত্বপূর্ণ ‘এক অঞ্চল এক পথ’-এর যাত্রা। এখানকার মানুষের মধ্যে একটি কুসংস্কার প্রচলিত আছে, কোনো সংখ্যার শেষে শূন্য থাকা অমঙ্গলজনক। আশ্চর্যজনকভাবে ২০২০ সালের শুরুটাই করোনাভাইরাসের মতো প্রাদুর্ভাব কেড়ে নিয়ে গেল উৎসব, আনন্দ; কেড়ে নিয়ে গেল শত শত প্রাণ, লাখ লাখ মানুষের হাসি আর পুরো বিশ্বকে আটকে দিল বন্দিশালায়।

চাংয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটেছে চেরি ফুল, অবরুদ্ধ দিনের পর শিক্ষার্থীরা দেখছেন বসন্ত। ছবি: লেখক
চাংয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটেছে চেরি ফুল, অবরুদ্ধ দিনের পর শিক্ষার্থীরা দেখছেন বসন্ত। ছবি: লেখক

এই মহামারির সময়ে চীনাদের নিয়ে নতুন কিছু উপলব্ধি করতে পেরেছি। চীনে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮২ হাজার, মৃত্যুর সংখ্যা ৩ হাজার ৩০০। যার মধ্যে শুধু হুবেই প্রদেশে আক্রান্ত ৬৮ হাজারের মতো (পুরো দেশের প্রায় ৮৩ শতাংশ) এবং মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ২০০ (পুরো দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ)। আর ঠিক পাশের প্রদেশ হওয়ার পরও আমাদের প্রদেশে মোট আক্রান্ত ব্যক্তি ২৫০ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৩ জন। অর্থাৎ হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর অন্যান্য শহরে ছড়িয়েছে খুবই কম। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশে এমন সফলতা সম্ভব হয়েছে এ দেশের মানুষের ধৈর্য ও সরকারের সঠিক পদক্ষেপের কারণে। এ দেশের জনগণ সরকারের সব সিদ্ধান্ত ও স্বাস্থ্যগত নির্দেশনা মেনে চলেছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছি, জাতি হিসেবে চীনারা কতটা শক্তিশালী। একটি উদাহরণ দিই, এ দেশে আর্থিক লেনদেনের জন্য নগদ টাকার ব্যবহার হয় খুবই কম, বেশির ভাগ লেনদেন হয় মুঠোফোনের মাধ্যমে। যার ফলে মুদ্রা লেনদেনের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি এখানে ছিল না। প্রযুক্তি ও ঐতিহ্যগতভাবেই তারা শক্তিশালী, একতাবদ্ধ হয়ে ভয়কে জয় করে সেটা দেখিয়ে দিল আবার।

শিয়ান শহর যখন অবরুদ্ধ ছিল।
শিয়ান শহর যখন অবরুদ্ধ ছিল।

আমরা চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সৌভাগ্যবান এ কারণে যে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমাদের এখানে শীতকালীন ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল, অধিকাংশ শিক্ষার্থী চলে গিয়েছিল নিজ নিজ বাড়িতে, ক্যাম্পাস ছিল অনেকটাই ফাঁকা। আমার পিএইচডি গবেষণার কাজের জন্য ক্যাম্পাসেই থেকে গেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসেই দীর্ঘ দুই মাস গৃহবন্দী ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যাওয়া কিংবা বাইরের কারও ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা, কোনোটারই সুযোগ ছিল না। খাবারের জন্য ক্যাম্পাসের ভেতরে ছোট্ট একটি বাজার (মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য) ছিল একমাত্র ভরসা, সপ্তাহে দুই দিন বাজার করার অনুমতি ছিল। এ দুঃসময়ে একটি ভালো দিক হলো, আমি আমার রন্ধনশৈলী বাড়িয়ে নিতে পেরেছি (রান্না করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না)। সেই সঙ্গে আরও অনেকে যাঁরা রান্না করতে পারেন না, তাঁদেরও সহযোগিতা করেছি রান্না করে খাবার প্রদানের মাধ্যমে। এখানকার শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ সবার সহযোগিতা ছিল শতভাগ। প্রতিদিন আমাদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা, থার্মোমিটার, মাস্ক সরবরাহ করাসহ স্বাস্থ্য সচেতনতা ও নিরাপদে থাকার সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে চলতে সহযোগিতা করেছেন। চীনা নাগরিকদের মতোই আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীরাও প্রাত্যহিক জীবনকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম ঘরবন্দী সময়ে।

১৫ মার্চ থেকে আমাদের শহরে জীবনযাপন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। খুলে দিয়েছে অফিস–আদালত, বিপণিবিতান, চলতে শুরু করেছে গণপরিবহন। ২৩ মার্চ থেকে সবচেয়ে ভোগান্তির শহর উহানও উন্মুক্ত ঘোষণা করে দিয়েছে সরকার। কয়েক দিন ধরে নতুন করে আক্রান্ত ব্যক্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে না চীনে, যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে বেশির ভাগই অন্য কোনো দেশ থেকে আসা।

উৎসবের এই শহরে ফিরতে শুরু করেছে প্রাণের স্পন্দন, বরফঠান্ডা শীত শেষে এবার এসেছে সত্যিকারের বসন্ত, যার সৌন্দর্য অফুরন্ত, যার রং শুধুই উজ্জ্বল, মানুষের মুখে ফিরে এসেছে হাসি, জীবন পেয়েছে মুক্তির স্বাদ। ক্যাম্পাসে ফুটেছে নানা প্রজাতির চেরি ফুল, সুবাস ছড়াচ্ছে নতুন আহ্বানের। এখানে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এখন হিসাবের খাতায়, প্রতিটি শ্বাস এখন নতুন শক্তি।