আছি সচেতনতায়, আছি মানবতায়

>দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার যখন শুরু হলো, তখন থেকেই কাজ করছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। কেউ প্রচার করছেন সচেতনতার বার্তা, কেউ বিতরণ করছেন জীবাণুনাশক, কেউবা এগিয়ে এসেছেন অবরুদ্ধ অসহায় মানুষের জন্য অন্নের সংস্থান করতে। এমনই দুটি উদ্যোগের কথা লিখেছেন সজীব মিয়া
রিকশাচালকদের হাতে নিত্যপণ্যের ব্যাগ তুলে দিচ্ছেন ঢাকার তিন তরুণ। ছবি: সংগৃহীত
রিকশাচালকদের হাতে নিত্যপণ্যের ব্যাগ তুলে দিচ্ছেন ঢাকার তিন তরুণ। ছবি: সংগৃহীত

মেঘনাদের ভালোবাসার বৃষ্টি

তিন বন্ধুর মনে হয়েছিল ‘কিছু করা উচিত’। এই কিছু করার তাড়না থেকেই তাঁরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বল্প মূল্যে মাস্ক সরবরাহের। কে না জানে, করোনাভাইরাসের প্রকোপের খবরে মাস্ক নিয়ে কেমন হুলুস্থুল কাণ্ডটাই না হলো শহরময়। তখন তিন বন্ধু শরীফ হোসাইন, রাফসান হাসান আর মো. তাইজুল ২৫ টাকায় মাস্ক সরবরাহের উদ্যোগ নিলেন। মাস্ক বিক্রি করে প্রতিটিতে লাভ হতো পাঁচ টাকার মতো। সে লাভের অর্থে তৈরি হলো তহবিল।

কী করবেন সেই তহবিলের টাকা? এই প্রশ্ন যখন উঁকি দিয়েছিল তাঁদের মনের ভেতর, তখনই অনেক মানুষ হতে থাকল স্বেচ্ছা-ঘরবন্দী। তারপর এল ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যান চলাচল বন্ধের ঘোষণা। শরীফ হোসাইন বন্ধুদের কাছে আসিফ নামে পরিচিত। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা পুরান ঢাকায় থাকি। সদরঘাট থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হলে এখানকার কুলি, ঠেলাচালক আর রিকশাচালকেরা কর্মহীন হয়ে পড়লেন। তাঁদের মধ্য বৃদ্ধ মানুষের অবস্থা আরও শোচনীয়।’

তাঁরা এই আকস্মিক কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের সহায়তা করতে চাইলেন। ঘোষণা দিলেন ফেসবুকে। সহায়তা চাইতেই অনেকে এগিয়েও এলেন। যাঁদের কেউ ১০০ কি ৫০০ টাকা অনুদান নিয়ে, কেউবা প্রচার করলেন উদ্যোগের কথা।

তিন বন্ধুর সেই তহবিলের সঙ্গে যোগ হলো পরিচিতদের এই সহায়তা। সে টাকায় কেনা হলো চাল, ডাল, তেল, সাবান। তাঁরা ছুটলেন পুরান ঢাকার সদরঘাট, ফরাশগঞ্জ,  তাঁতীবাজার, বাংলাবাজার এলাকার বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা এবং অসহায় কুলিদের কাছে। ২৫ জনের হাতে তুলে দিলেন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর একটি করে ব্যাগ। যে ব্যাগ ছিল পাঁচ কেজি চাল, তিন কেজি আলু, একটি করে কাপড় কাচার ও গোসলের সাবান, আধা কেজি তেল ও এক কেজি মসুর ডাল।

তাঁরা তাঁদের উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘মেঘনাদের প্রথম বৃষ্টি বর্ষণ’। মেঘনাদ তিন বন্ধুর একটি ব্যবসায় উদ্যোগের নাম। তাঁদের সহায়তা মূলত হঠাৎ বৃষ্টির মতো ভালোবাসা, তাই বৃষ্টি বর্ষণ। আসছে দিনগুলোতে যেহেতু সংকট বাড়বে, তাই এই কাজ তাঁরা চালিয়ে নিতে চান আরও কয়েক ধাপে, সে কারণেই যুক্ত করেছেন ‘প্রথম’ শব্দটি।

শরীফ হোসাইন বলেন, ‘আমাদের উদ্যোগটা সামান্য।  আরও হাজারো মানুষ এমন অসহায় অবস্থায় আছেন। কিছুদিন পর সংকট আরও বাড়বে, জানি না তখন কী হবে। তবে আমরা আছি নিজেদের সাধ্যমতো।’

জীবাণুনাশক ছিটিয়ে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে সিলেটের একদল তরুণ। ছবি: আনিস মাহমুদ
জীবাণুনাশক ছিটিয়ে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে সিলেটের একদল তরুণ। ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেটে সচেতনতার বার্তা

ঝরনা চৌধুরী একটি বিষয় লক্ষ করলেন। করোনা নিয়ে কথা বলছে সবাই, কিন্তু সচেতনতা নেই অনেকের। দেশের অনেক এলাকার মানুষের মতো সিলেট শহরেও দেখা যাচ্ছিল কেউ কেউ তখনো দলেবলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রাস্তার পাশের দোকানে চা পান করতে করতে তর্ক করছেন করোনা নিয়েই। তাঁদের হাবভাব এমন, যেন ভাইরাস যতই ছড়াক, তাঁর কিছু হবে না! রিকশাচালক আর অটোরিকশাচালকেরা বহন করছেন এমনই অসচেতন যাত্রীদের।

ঝরনা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা চাইছিলাম এই মানুষদেরই সচেতন করা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই প্রচারণার কাজ শুরু করি।’

ঝরনা সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রধান কর্মসূচি সমন্বয়ক হিসেবে যুক্ত আছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি বাংলাদেশ (পিপিএস) নামে সংগঠনের সঙ্গে। এই সংগঠনের মাধ্যমেই তরুণ সদস্যদের নিয়ে শুরু করলেন প্রচারণার কাজ। ২৬ মার্চ মুঠোফোনে সেসব কাজের কথাই শোনাচ্ছিলেন তিনি।

তাঁরা সিলেট শহরকে কয়েকটি অংশ ভাগ করে ফেলেন। শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলেও ২৪ মার্চ থেকে এসব এলাকায় গিয়ে পথচারী, রিকশাচালক, অটোরিকশাচালকদের সচেতনতার কথা বলতে থাকেন। শুধু সচেতনতার বার্তায় নয়, নিজেরা সুরক্ষিত পোশাক পরে ছিটিয়ে দেন জীবাণুনাশক।

ঝরনা বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন আটজনের দলটি নির্দিষ্ট এলাকায় হাজির হতাম। তারপর রিকশা, অটোরিকশায় জীবাণুনাশক স্প্রে করতাম, চালকদের বোঝাতাম তাঁরা কীভাবে আক্রান্ত হতে পারেন এবং কী উপায় অবলম্বন করলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকটা এড়িয়ে যেতে পারেন।’

শুরুতে তাঁদের কথায় মানুষ খুব যে গা করতেন, এমন নয়। তবে দেশে যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল, নতুন নতুন এলাকা অবরুদ্ধ হতে থাকল, তখন অনেকে নমনীয় হলেন। অনেক সময় নিজেই আগ্রহ নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করতেন পানি আর ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করে জীবাণুনাশক তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে।

ঝরনা চৌধুরী যেমনটি বলছিলেন, ‘মানুষ হয়তো শুরুতে বাহবা দেয়নি কিন্তু দিন গড়াতেই সাধুবাদ জানাল। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেও আমাদের এই সাধুবাদ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’

বর্তমানে সবাই ঘরে থাকলেও দিনের একটি সময় বের হয়ে সচেতন করার কাজটি তাঁরা অব্যাহত রেখেছেন। আসছে দিনগুলোতে পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি নামের সংগঠনটির সদস্যরা অসহায় মানুষদের খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবেন বলে জানালেন ঝরনা।