এই দুঃসময়ে বেঁচে থাকার গল্প

>ঘরবন্দী এই সময়ে চাইলে পরিবারের মধ্যেই গড়ে তোলা যায় সৃজনশীলতার চর্চা। কীভাবে? সে কথা গল্পের ছলে লিখেছেন শিল্পী কনক আদিত্য
সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে কাটানো যায় এই অস্থির সময়। ছবি: লেখক
সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে কাটানো যায় এই অস্থির সময়। ছবি: লেখক

টিভির সামনে বসে থাকতে থাকতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে তাঁর। করোনা নিয়ে এত এত তথ্য, নির্দেশনা, আপডেট আর নিতে পারছেন না। পাশের ঘর থেকে তাঁর মা সেতারা বেগম হাঁক দেন, ‘দ্যাখ তো বাবা রবি, বাচ্চা দুটো ঝগড়া করছে কী নিয়ে?’ রিভু আর রিতু তাঁর দুই ছেলেমেয়ে। মায়ের মোবাইল নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে ভাইবোনের মধ্যে। কীই–বা করবে আর বাচ্চারা! রিভু সেভেনে আর রিতু মাত্র ফাইভে। স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে ১০ দিনের বেশি। বাইরে যেতে পারছে না। কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে। বসে বসে টিভি আর কতক্ষণ দেখবে।

বসার ঘরের পাশের ঘরটায় ছোট ভাই তমালের সঙ্গে রিভুও থাকে। সে ঘর থেকেই গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। তমালের কণ্ঠটাও বেশ। ওর ফাইনাল ইয়ার চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর থেকেই আর বের হচ্ছেন না ঘর থেকে। পড়ছেন, না হয় অনলাইন ক্লাস করছেন। বেশির ভাগ সময় কাটছে অবশ্য ফেসবুকে। অনেক দিন পর ওকে গাইতে শুনছেন রবি। গানের কথাগুলো বেশ চেনা চেনা লাগছে। তখনই গিটার হাতে রবির পাশে এসে বসলেন তমাল। ‘ভাইয়া, তোমার সেই কবিতাটায় সুর বসিয়ে ফেললাম আজ। একটা দৈনিকের সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। কত দিন তোমার নতুন লেখা পাচ্ছি না। ঘরবন্দী থাকাকালে আরও কিছু লেখো না আমাদের জন্য।’

সরকারি কলেজে সাহিত্য পড়ান রবিউল ইসলাম রবি। এখন সহকারী অধ্যাপক। ক্লাসের প্রস্তুতি, পরীক্ষা, খাতা দেখা—নানা ব্যস্ততায় আগের মতো আর নিয়মিত লেখা হয় না তাঁর। তমালের কথাটা নিয়ে ভাবছেন তিনি। কিছু একটা শুরু করে দেবেন নাকি! গোটা কয়েক গান, নাকি কবিতা? একটা গল্পের প্লটও ঘুরছে মাথায়। দেখা যাক...

এই গৃহবন্দী সময়ে সারা দিন এ ঘরে–সে ঘরে থাকলেও খাওয়ার সময় সবাই একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসে যান। রাতে খাওয়ার সময় রবি তাঁর ভাবনার কথাটা বলা শুরু করেন। ‘আমরা কি একটা উৎসব করতে পারি না এই দমবদ্ধ সময়ে। পারিবারিক সাহিত্য উৎসব।’

 ‘ঝেড়ে কাশ ভাইয়া’, সহাস্যে বলে উঠলেন তিতলী। রবির ছোট বোন। পিএইচডি করছেন কানাডায়। মাস তিনেক আগে বেড়াতে এসে এখন আটকা পড়েছেন দেশে। রবি পুরো প্ল্যানটা বলতে থাকেন, ‘বাসার সবাইকেই কিছু না কিছু লিখতে হবে। ছড়া, কবিতা, গান, গল্প কিংবা প্রবন্ধ। যার যা মন চায়। যেকোনো বিষয় হতে পারে। সময় সাত দিন। মানে সামনের শনিবার বিকেল থেকে শুরু হবে উৎসব। যার যার লেখা সে সে পাঠ করবে। তারপর সেই লেখা নিয়ে চলবে আলোচনা।’

 ‘বাহ্ দারুণ! চমৎকার প্ল্যান ভাইয়া।’ তিতলী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে থাকেন, ‘উৎসবের দিনে কিন্তু বিশেষ খাবারদাবারের আয়োজন করতে হবে। নাহলে আর উৎসব কেন!’ রিভু–রিতুর মা বিনু যোগ করেন, ‘তবে সেদিন একটা কাজ করা যায় না, সবাই অন্তত একটা করে আইটেম রান্না করবে ঘরে যা আছে তা–ই দিয়ে। সকাল সকাল শুরু করলে দুপুরের মধ্যেই হয়ে যাবে আশা করি।’ তমাল বোকার মতো বলে ওঠেন, ‘আমি তো ডিম ভাজা ছাড়া আর কিছু পারি না ভাবি।’

 ‘ইউটিউব আছে না কাকু! ভিডিও দেখে সব শিখে ফেলা যায় এখন।’ রিতুর পাকনামিতে সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন। রিভু দাদিকে বলে, ‘তোমাকেও কিন্তু একটা গল্প লিখতে হবে দাদু। তুমি কত সুন্দর সুন্দর গল্প শোনাও আমাদের। তেমনই একটা চাই কিন্তু।’

পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে তিতলী আরেকটা নতুন প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। ‘আজ আমরা ঘর গোছাব। সাজাব। অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জিনিস ফেলে দিলেই কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’ দুই পিচ্চি সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে বলে উঠল, ‘আমরাও আছি ফুফি তোমার সঙ্গে।’ বিনু বললেন, ‘কিছু পুরোনো কাপড় আর কাগজ রেখে দিয়ো আমার জন্য। কিছু পুতুল বানানো যায় কি না দেখি।’ পুতুলের কথা শুনেই রিতুর চোখ চকচক করে উঠল। রিভু তখন বলে, ‘কাগজগুলো নিশ্চয়ই অরিগ্যামি করার জন্য। আমি কিন্তু নৌকা আর প্লেন বানাতে পারি কাগজ দিয়ে।’ ছেলের কথায় সায় দেন মা। ‘এবার আরও অনেক নতুন কিছু বানানো শিখব কাগজ ভাঁজ করে।’ রিতু দুষ্টুমির সুরে আবার পাকামি করে, ‘ইউটিউব আছে না!’ হাসির ফোয়ারা ছোটে টেবিলজুড়ে।

‘কী আপু! ঘর গুছিয়ে খুব টায়ার্ড?’ তমালের কথায় তিতলী সায় দেন। ‘হুম! টায়ার্ড হলেও মনটা বড় ফুরফুরারে ভাই। দ্যাখ বাড়িটা কী ঝকঝক করছে। আর পিচ্চি দুটোকে দ্যাখ একদম ঝলমলে চেহারা। ক্লান্তির ছাপমাত্র নেই একফোঁটা। তমাল, রাতের খাওয়া শেষ হলে গান শোনাবি আজ। প্লিজ! লক্ষ্মী ভাই আমার।’

খাওয়া শেষে সবাই লিভিং রুমে আরাম করে বসে আড্ডা দিতে শুরু করেন। তমাল একফাঁকে নিজের ঘর থেকে ব্লুটুথ স্পিকারটা নিয়ে আসেন। ‘কিরে! গিটার না এনে স্পিকার নিয়ে এলি যে?’ অনুযোগের সুর তিতলীর কণ্ঠে। ‘আজ আমি গান করব না। সবাই সবার পছন্দের গান শুনব। যেকোনো গান। দেশি–বিদেশি সব। নতুন–পুরোনো সব। মা, তোমাকে দিয়েই শুরু করি। বলো, তোমার পছন্দের গান কী? কোন গান শুনবে?’ ছেলের কথায় মা বলেন, ‘আমার সময়ের গান কি আর তুই এখন শোনাতে পারবি?’ সঙ্গে সঙ্গেই রিতুর পাকামি, ‘ইউটিউব আছে না দাদু।’

বিনু আর তিতলী বাচ্চাদের সঙ্গে মিলে অনেক পুতুল বানিয়ে ফেলেছেন। ছোট-বড়, লম্বা-বেঁটে, শুকনা-মোটা নানান পদের পুতুল। অনেক অনেক কাগজের খেলনা ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। ফুল, পাখি, তারা, কুকুর, ব্যাঙ। সব কাগজ ভাঁজ করে করে। আনন্দে আত্মহারা রিভু–রিতু। ওরা নাকি ওগুলো দিয়েই বাড়ি সাজাবে উৎসবের দিনে। ওদের উচ্ছ্বাসে রবি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।

এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, এত হইচই! কিন্তু সেতারা বেগমকে এদিকটায় তেমন দেখা যাচ্ছে না। রবি মায়ের ঘরে যান খোঁজ নিতে। নাতিদের পুরোনো খালি খাতায় তিনি লিখে চলেছেন। গভীর মনোযোগ খাতার দিকে। রবির দিকে একটি বার ফিরেও তাকালেন না। হয়তো টেরই পাননি তিনি। নিজের ঘরে ফিরে এসে টাইপ করতে বসে গেলেন রবি। শিরোনাম দিয়েই শুরু করলেন লেখা। কন্সপিরেসি থিওরি অব করোনা।

কোথায় গেল কোথায় গেল বলে বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলেছে রিতু। টয়লেট টিস্যুর ভেতরের কাগজের টিউব জমানোর বাতিক তার। তা-ই খুঁজছে সে। ঘর গোছানোর পর থেকে নাকি সেগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না। তিতলীই বের করে আনল ফেলে দেওয়া জিনিসের বস্তা খুঁজে। ওমা! বিকেলের মধ্যেই দু-দুটো পুতুল বানিয়ে ফেলল রিতু। সঙ্গে একটা কলমদানিও।

সন্ধ্যার আগে আগে রিভু এসে বাবাকে বলল তার লেখা শেষ। বাবাকে শোনাতে চায়। রবি ছেলেকে চুপি চুপি বললেন, ‘উৎসবের আগে শোনানো যাবে না বাবা। এখন শোনালে তো উৎসবের দিনে নতুন জিনিসের মজা পাওয়া যাবে না। ঈদের নতুন জামার মতো। তবে এতটুকু বলতে পারো যে তুমি কী লিখছ—ছড়া না গল্প।’

এটা-সেটা করে সাঁই সাঁই করে দিন কেটে যাচ্ছে। ওদিকে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ঘটে চলেছে একের পর এক ঘটনা। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে। পরিজন নিয়ে ঘরে থাকাই সবার জন্য ভালো এ মুহূর্তে। রবি আর ভাবতে পারছেন না। তার চেয়ে বরং লেখায় মনোযোগ দেওয়া যাক।

দুদিন পরেই উৎসব। সবার লেখাই প্রায় শেষ। কারও কারও শেষের দিকে। বাচ্চারা দাদির কাছে অনেক আবদার করেও জানতে পারেনি তিনি কী লিখেছেন। একদম তালা মেরে রেখেছেন মুখে। বিকেলে এমনই একটি ছবি এঁকেছে রিভু। দাদুর মুখে তালা। তা–ই দেখে রিতু বেশ কিছু কাগজ, পেনসিল, রং–পেনসিল নিয়ে হাজির। সবার হাতে কাগজ-পেনসিল ধরিয়ে দিল। সঙ্গে চলছে নির্দেশনা। ‘বাবা তুমি আঁকবে মায়ের মুখ আর মা তোমাকে আঁকবে।’ এমনি করে সবাই সবাইকে আঁকবে বলে সে তার ভাইকে আঁকা শুরু করে দিল। এই দেখে মা বললেন, ‘আরেহ্! আমরা কি আর তোদের মতো আর্টিস্ট নাকি! আমরা কি আর আঁকতে পারি!’ ভাবির অসহায়ত্ব দেখে তমাল বলেন, ‘পারবে পারবে, শুরু করেই দেখো না একটিবার।’ রবি মনে মনে হাসেন আর ভাবেন, যা ছিরি হবে না একেকজনের চেহারার। সত্যিই তা–ই, কারও মুখ ব্যাঙের মতো, কারোরটা উটের মতো, কিন্তু সময়টা কাটল দারুণ। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে সবার।

সাতটা দিন ফস করে চলে গেল। আজ শনিবার। আজই পারিবারিক সাহিত্য উৎসব। সবার লেখা শেষ। সকাল থেকে রান্না শুরু হয়েছে। গত রাতেই বাচ্চারা বসার ঘর সাজিয়েছে তাদের বানানো জিনিসপত্র দিয়ে। দেয়ালে দেয়ালে ফুল–পাখি দুলছে। যেন আনন্দে নাচছে। উৎসবে মাতোয়ারা।

রিতু লিখেছে রূপকথা—প্রজাপতি আর রাক্ষসের গল্প। রিভু ছন্দে ছন্দে লিখেছে নদী আর মাছের ছড়া। তমালের নতুন গান। একেবারে গেয়েই শুনিয়েছেন। তিতলীর সায়েন্স ফিকশন। বিনুর কবিতা। প্রতিটা পাঠ শেষে আলোচনা–সমালোচনা। রবির প্রবন্ধ নিয়ে তো তুলকালাম তর্ক। সবার শেষে সেতারা বেগমের গল্প—জীবনগাথা। পড়ছেন তিনি। পড়তে পড়তে হাসছেন কখনো আবার চোখ ছলছল করে উঠছে। আসলে পড়ছেন না, গল্প বলছেন। জীবনের গল্প। হাসি–কান্নার গল্প। হারানোর গল্প। পাওয়ার গল্প। আসলে বেঁচে থাকারই গল্প।