অদৃশ্য দৈত্যের আতঙ্কে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মাস্টার্সের ক্লাস, অধ্যাপকের সহকারী হিসেবে গবেষণা এবং পেশাদার পাইলট হিসেবে যোগদানের জন্য প্রশিক্ষণের চাপ—মনে মনে কতবার যে লম্বা ছুটি চেয়েছি। অবশেষে এল সেই ছুটি। এখন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে প্র্যাকটিস ফ্লাইটে যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসে জটিল কোনো গবেষণার কাজ করা ছাড়াই স্বাভাবিক নিয়মে বেতন পাচ্ছি। ক্লাস, প্রজেক্ট, পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চলছে। কিন্তু আচমকা মনে হচ্ছে, আমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে। অদ্ভুত লাগছে, দমবন্ধ লাগছে!

একটি সাজানো কমপ্লেক্সে, লেকভিউ ছোট অ্যাপার্টমেন্টে ফ্লোরিডায় আমার বাসা। আপাতত সেলফ আইসোলেশনে আছি। স্রষ্টাকে ডাকছি, যোগব্যায়াম করছি, পুরোনো ফেলে রাখা বেশ কিছু কাজ গুছিয়ে উঠেছি, অনলাইনে ক্লাস করছি, পড়ছি, দেশীয় খাবার রান্না করছি। বিকেলে প্রতিবেশীদের ঝুলবারান্দা থেকে কি–বোর্ড, বেহালার ভেসে আসা সুরের সঙ্গে নিজের উকুলেলে বাজানোর বৃথা চেষ্টা চলছে। দেশ থেকে এক বন্ধুর পাঠানো চাচা চৌধুরী, নন্টে-ফন্টে, তিন গোয়েন্দাসহ আরও কিছু প্রিয় বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ পড়ছি। এই এক টুকরো ছেলেবেলা নিয়েই আছি।

এখানকার আবহাওয়া চমৎকার। চারপাশে ভালো থাকার উপকরণ যথেষ্ট। তবু আমার কিছুই ভালো লাগছে না। পৃথিবীর অনেক অনেক মানুষের মাথা গোঁজার একটু জায়গা নেই, দিনমজুরের খাবারের জোগান নেই। আমার কাছে জীবন মানে আমার সাধ্যের মধ্যে থেকে মানুষের কাজে আসা আর ভালোবাসা পাওয়া। যেসব সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি, সব কটি দলের কাজ বন্ধ। পাশের বাড়ির ৮৫ বছর বয়সের প্রতিবেশীর সঙ্গে রোববার বিকেলে নিয়ম করে হাঁটতে যেতাম, সেটাও বন্ধ। কিছু বন্ধুকে হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হওয়ায়, তাঁদের ফেলে যাওয়া কিছু কাগজপত্র পাঠানো দরকার। কিন্তু আবাসিক ভবন থেকে পোস্ট অফিস অবধি পৌঁছানোর কাজটুকু করা যাচ্ছে না। মোটামুটি নিজেকে ‘মানুষ’ হিসেবে দাবি করার ‘মানবিক’ সব কাজের দরজা যেন বন্ধ।

আমরা ভালো থাকি নিকটজনদের নিয়ে। আমরা ভালো থাকি আমাদের কাছের মানুষের সুস্থতায়। আমরা ভালো থাকি চারপাশের সবার আন্তরিকতায়। একা একা ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকুক আমার মা, বাবা, ভাই, বোন। ভালো থাকুক আত্মীয়, বন্ধু আর তাঁদের প্রিয়জন। ভালো থাকুক আমার দেশের সব মানুষ। পৃথিবী সেরে উঠুক, সচেতনতা বাড়ুক, এই অস্থির সময় কেটে যাক। অদৃশ্য দৈত্য ঘায়েল হোক।