বিষাদমাখা বৈশাখ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কক্সবাজারের উখিয়ায় যে বাসায় আমি থাকি, সে বাসাতেই থাকে তিথিলা। রাখাইন সম্প্রদায়ের মেয়ে। গত মাসের শুরুতে তিথিলা ওদের ঐতিহ্যবাসী পোশাক থামি এনে হাতে দিল। সঙ্গে জানাল আমন্ত্রণ, পয়লা বৈশাখে ওদের বড় উৎসব সাংগ্রাইন, আমাকে অবশ্যই ওদের বাসায় যেতে হবে। তার আমন্ত্রণ এড়িয়ে বললাম, আমার তো জরুরি কাজে বাড়ি যেতে হবে!

কয়েক বছর ধরে পয়লা বৈশাখ এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদেরও এভাবেই এড়িয়ে চলেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, বকুলতলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার বটমূল ও রঙিন ক্যাম্পাসের পান্তা-ইলিশের ডাক অগ্রাহ্য করেছি।

আব্বু জানো, সেই বৈশাখের পর থেকে আমাকে আর কিছুই টানে না। আমার শুধু মনে হয় বাড়ি যাওয়ার পথটায় কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে পৌঁছালেই একটা ঠান্ডা বাতাস আমাকে স্পর্শ করবে, আমার সব ক্লান্তি নিয়ে নেবে।

সেই বৈশাখে তুমি আমাকে ১ হাজার ২০ টাকা পাঠালে। সেই টাকা তুলে সন্ধ্যায় আজিজ সুপার মার্কেটে গেলাম। ৮০০ টাকার এক তাঁতের শাড়ি কিনলাম। শাহবাগ থেকে ফেরার পথে নিলাম চুড়ি, টিপ, মালা। রাতে কত হাসি-গল্প হলো আমাদের। আমি তো তখনো কিছু জানি না। বুঝতেও দাওনি কিছু।

পয়লা বৈশাখের সকালে তারা মিথ্যে বলে ঢাকা থেকে তোমার কাছে নিয়ে গেল। এত মানুষ বাড়িতে আমি দেখিনি কখনোই। কালো আরবি হরফে লেখা মখমলের চাদরে ঢাকা তোমার শরীর, চোখে সুরমা আঁকা, তুমি ম্লান হাসছিলে। আমি মাথা ঝুঁকে চোখ বন্ধ করে তোমার থেকে পুরোটা আতরের গন্ধ নিলাম। তোমাকে স্পর্শ করতে নিষেধ করেছে, আমি শুনিনি। আমারই তো আব্বু, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁর পরিচয় কেন লাশ হবে?

তখন থেকে বৈশাখ এলেই ক্যাম্পাসের সব উৎসবের ভিড়ে আমার কেমন অস্থির লাগতে শুরু করে। কোনো কিছুই টানে না, গোরস্থান মোড়ে রাস্তার পাশে যে সবুজ ঘাসের সঙ্গে তুমি মিশে গেছ, কাছে ডাকে সেইখান থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস। যে বাতাসে তুমি আছ বলে আমি বিশ্বাস করি। আর সেই শাড়ি, চুড়ি, টিপ ড্রয়াের রেখেছি যত্ন করে। আজকাল প্রায়ই ড্রয়ারে থেকে বের করে দেখি। রাতভর পায়চারি করি, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। দীর্ঘশ্বাসগুলো বাতাসে মিলিয়ে যায়, তোমার কাছে পৌঁছায় কি না, জানি না।

পয়লা বৈশাখ গেল। কিন্তু এবার তোমার কাছে আর যাওয়া হলো না। পৃথিবীর কী এক অসুখ করেছে। অদৃশ্য ভাইরাসের কবল থেকে কবে মুক্তি পাবে সবাই, আমি সেদিন তোমার কাছে যাব।

 
উখিয়া, কক্সবাজার