কথায় জেতার কৌশল

 ‘নেগোসিয়েশন’ শব্দটা শুনলেই আমার মাথায় চলে আসে থ্রিলার উপন্যাসের টান টান রোমাঞ্চের মূহুর্ত। মনে হয় তুখোড় কোনো গোয়েন্দা আর ধুরন্ধর এক অপহরণকারী মুখোমুখি, দুজনই চেষ্টা করছে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে। বিজনেস স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর অবশ্য জেনেছি, নেগোসিয়েশন এক ভীষণ জরুরি জীবন দক্ষতা।

‘নেভার স্প্লিট দ্য ডিফারেন্সঃ নেগোশিয়েটিং অ্যাজ ইফ ইয়োর লাইফ ডিপেন্ডস অন ইট’ বইতে এই দক্ষতা সম্পর্কেই িলখেছেন ক্রিস্টোফার ভস ও তা’ল রাজ। এখানে বলে রাখি, ভস একজন মার্কিন লেখক, অধ্যাপক ও ব্যবসায়ী। তবে ভসের ঝুলিতে রয়েছে দীর্ঘ ২৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা, এফবিআইয়ের হয়ে ‘নেগোশিয়েটর’ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে তা’ল রাজও প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও সম্পাদক। তবে সত্যি কথা বলতে, ভসের রোমাঞ্চকর পেশার কথা জানার পরই বইটি পড়তে আগ্রহী হয়েছিলাম আমি। 

কী করে নিজের প্রস্তাবকে যৌক্তিক করে তুলতে হবে, কীভাবে দর কষাকষির মোড় নিজের দিকে ঘোরাতে হবে, কোন উপায়ে নেগোসিয়েশন নিজের জন্য লাভজনক করা যাবে, ইত্যাদি শর্টকাট বিষয়কে নাকচ করে দিয়েছেন লেখকদ্বয়। বলেছেন ‘উইন-উইন’ সিচুয়েশনের কথা, যেখানে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি থেকেই গৃহীত হবে সিদ্ধান্ত। ভস ও রাজের মতে, ‘হিসেবী যুক্তি বা কৌশল’ নয় বরং ‘এমপ্যাথি বা সহমর্মিতা’ এবং ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা আবেগজনিত বুদ্ধিমত্তা’ থেকেই ফলপ্রসূ আলোচনা সম্ভব। বইটিতে বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে, ‘ভুলে যেয়ো না, যার সঙ্গে দর কষাকষি করছ, সে কলকব্জার তৈরি রোবট নয়। সে-ও তোমার মতোই একজন মানুষ।‘

বাস্তব পৃথিবীর উদাহরণ এতে বারবার এসেছে। তবে হয়তো নিরাপত্তাজনিত কারণে ভসের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার উল্লেখ এতে কমই পাওয়া যায়। তবু যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নেগোসিয়েশনের ঘোরপ্যাচকে আপনার কাছে খানিকটা সহজ করে তুলতে পারে সেসব হলো:

১. অন্যের কথা শুনতে হবে মন দিয়ে। অপরপক্ষ কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে, কোন উপায়ে অগ্রসর হতে চাইছে, এসব বুঝতে হলে তাদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা জরুরি।

২. নেগোসিয়েশন চলাকালীন আপনার কন্ঠস্বর হবে তিন রকম; এফ এম ডিজে ভয়েস, প্লেফুল পজিটিভ ভয়েস এবং ডিরেক্ট অ্যাসার্টিভ ভয়েস। এফ এম ডিজে ভয়েস মূলত শান্ত-সৌম্য ভঙ্গিতে আলোচনায় সহজ সুর নিয়ে আসে আর প্লেফুল পজিটিভ ভয়েস নিশ্চিত করে সৌহার্দ। ডিরেক্ট অ্যাসার্টিভ ভয়েস কম ব্যবহারের পরামর্শই দেওয়া হয়েছে বইটিতে। কারণ এর মাধ্যমে মূলত নিজের দৃঢ় ধারণা বা অবস্থান ব্যক্ত করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হয় না।

৩. ‘মিররিং’ নেগোসিয়েশনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অপরপক্ষ যা বলছে, তার যথাযথ প্রতিফলন বা সামঞ্জস্যতা আপনার আলোচনায় থাকা জরুরি। 

৪. সরাসরি ‘না’ বলার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনা নেতিবাচক দিকে মোড় নেয়। তাই যেখানে আপনি ‘হ্যাঁ’ বলতে চান না, সে উত্তরগুলোও হতে হবে যথেষ্ট বিনয়ী ও যৌক্তিক। ‘আমি আরেকটু ভেবে জানাবো’, ‘দুঃখিত আমি আসলে এখনই এতে একমত হতে পারছি না’ এমন উত্তরগুলো আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ‘হ্যাঁ’ মানেই আপনি চুক্তিবদ্ধ বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছেন। 

৫. ‘হ্যাঁ’ এর চাইতেও শক্তিশালী হলো ‘আপনি ঠিক বলেছেন’ বা ‘দ্যাটস রাইট’। এতে অপরপক্ষ যেমন উৎসাহিত হবে তেমনি আলোচনায় আসবে ইতিবাচক সুর। 

৬. নেগোশিয়েটর হিসেবে সফল হতে চাইলে ‘ফেয়ার’ বা ‘সৎ’ হিসেবে পরিচিত হওয়া ভীষণ জরুরি। কেননা এছাড়া বিশ্বাস অর্জন করা আপনার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। 

৭. অর্থনৈতিক নেগোসিয়েশনে যখন সংখ্যা নিয়ে কথা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট অংক না বলে ‘রেঞ্জ’ বা সীমা ঠিক করে দিন। যেমন, ‘আমি ১০,০০০ টাকায় কাজটা করতে পারব’ না বলে বলুন ‘ আমি দশ থেকে বারো হাজার টাকায় কাজটা করতে পারব।’ এতে অপরপক্ষের জন্য আলোচনার সুযোগ থাকে।

৮. মনে রাখতে হবে, নেগোসিয়েশনের শতকরা ৭ ভাগ নির্ধারিত হয় উচ্চারিত শব্দের উপর ভিত্তি করে। ৩৮ ভাগ নির্ধারণ করে আপনার কথা বলার ভঙ্গি এবং ৫৫ ভাগ নির্ধারণ করে আপনার শারীরি ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।