হেল্পলাইনের স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক

>জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩। বিশেষ নম্বরে ফোনকল করে পাওয়া যায় করোনাভাইরাসের তথ্যসেবাসহ চিকিৎসা পরামর্শ। যাঁরা সেবা দিচ্ছেন, তাঁরা সবাই চিকিৎসক। প্রত্যেকেই স্বেচ্ছাসেবী। নিজেদের রোজকার কাজের বাইরে দেশের চার হাজারের বেশি চিকিৎসক যুক্ত হয়েছেন একটি বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে। তাঁদের মাধ্যমে তথ্যসেবা পেয়েছেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। 
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত তান্‌নুম যুক্ত আছেন ৩৩৩ হেল্পলাইনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। ছবি: সংগৃহীত
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত তান্‌নুম যুক্ত আছেন ৩৩৩ হেল্পলাইনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। ছবি: সংগৃহীত

‘হ্যালো, আমি সাথি বলছি। জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এ কল করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ...।’

৩৩৩ নম্বরে কল করার পর সাথি নামের নারী কণ্ঠ এভাবেই স্বাগত জানাল। তার নির্দেশনা মেনে মুঠোফোনে ‘১’ বোতামটি চাপতে হলো। করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত সেবা পাওয়ার জন্য আরও কয়েকবার বোতাম চাপলে শুরু হলো অপেক্ষা। এই অপেক্ষা চিকিৎসকের সঙ্গে সংযুক্ত হতে। মিনিট দুয়েক পর সংযুক্ত হলেন একজন চিকিৎসক।

‘ডা. মো. আবুল হোসাইন বলছি...’, নিজের পরিচয় দিয়ে বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চাইলেন কুশল। আমার পেশাগত পরিচয় জানার পর রাজি হলেন নিজের সম্পর্কে বলতে। তিনি গাজীপুরে অবস্থিত দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা কর্মকর্তা। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন। তাই প্রাতিষ্ঠানিক কাজের ফাঁকে সময় দেন হেল্পলাইনে। তিনি বলছিলেন, ‘যতটুকু সময় দিতে চাই, ততটুকুই দেওয়া যায়। ব্যক্তিগত নম্বরটি অ্যাপের মাধ্যমে হটলাইনের সঙ্গে যুক্ত। “অন” ও “অফ” বোতাম থাকায় প্রক্রিয়াটি সহজ।’

আবুল হোসাইন প্রতিদিন শতাধিক ফোনকল গ্রহণ করেন বলে জানালেন। আন্তরিকতার সঙ্গে কথা শুনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। বলছিলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে মানুষকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করি। করোনাভাইরাস নিয়ে অধিকাংশ মানুষ আতঙ্কিত। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললে অনেকে উদ্দীপ্ত হন।’

আবুল হোসাইন যে অ্যাপটির কথা বললেন, সেটি বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচি এবং চিকিৎসকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্ল্যাটফর্মের ’একটি উদ্যোগ। নাম ‘করোনা ডক্টর পুল’। হটলাইনের সঙ্গে যুক্ত অ্যাপটিতে ৪ হাজারের বেশি চিকিৎসক নিবন্ধিত হয়ে সেবা দিচ্ছেন। এ ছাড়া মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কয়েকটি দল কাজ করছে তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায়। যাঁরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী।

এই স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসকদের সমন্বয়ক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (মেডিকেল বায়োটেকনোলজি) ডা. মো. মারুফুর রহমান। এই উদ্যোগের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি বললেন, গত মার্চে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকলে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ১৭টি হটলাইন নম্বর চালু করা হয়। কিন্তু কলের পরিমাণ এত বাড়ছিল যে চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখন এটুআই ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, এটি ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকেরা পছন্দমতো সময়ে হটলাইন সিস্টেমে যুক্ত থেকে ই-ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ দিতে পারবেন।

সে অনুযায়ী তৈরি হয় অ্যাপ। চিকিৎসক আহ্বান করা হয় প্ল্যাটফর্মের ফেসবুক গ্রুপে। মো. মারুফুর রহমান বলেন, ‘সে সময় নিরাপত্তা সামগ্রীর স্বল্পতার কারণে অনেকে ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ রাখছিলেন। কেউ কেউ টেলিফোনে সেবা দিচ্ছিলেন। এমন চিকিৎসকদের লক্ষ্য করেই উদ্যোগটা নেওয়া।’

আগ্রহী চিকিৎসকদের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অনলাইন কোর্স সম্পন্ন করা চিকিৎসকেরা সনদ নম্বরের মাধ্যমে অ্যাপে নিবন্ধন করে যুক্ত হন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। মো. মারুফুর রহমান বলেন, এই স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকেরা গত ২৪ মার্চ থেকে ৫ মে পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ কল গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে সরকারের টেলিমেডিসিন সেবাপ্রদানের নির্দেশিকা মেনে সাড়ে ৬ হাজার মানুষকে দিয়েছেন ই-ব্যবস্থাপত্র, কোয়ারেন্টিন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ২ হাজার ৬০৪ জনকে।

বেশি কল নিয়েছেন আবু তাহের

কোন চিকিৎসক কতটি কল গ্রহণ করেছেন বা সেবা দিয়েছেন, এ হিসাবও আছে অ্যাপটিতে। সর্বোচ্চ সংখ্যক কল গ্রহণ করেছেন চিকিৎসক আবু তাহের। ৫ মে পর্যন্ত তিনি ২ হাজার ৩৯৩ জনের কল গ্রহণ করেছেন।

আবু তাহেরকে পরিচিত মানুষেরা সবুজ নামে চেনে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার চিকিৎসা কর্মকর্তা তিনি। পেশাগত কাজের বাইরে মার্চ মাসেই যুক্ত হয়েছেন হেল্পলাইনের সঙ্গে। সর্বোচ্চ সেবাদাতা এই চিকিৎসক বলেন, ‘তথ্যটি জেনে আমি নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছি। আসলে ভালো লাগা থেকে কাজটা করি, তবু সংখ্যাটা জেনে আনন্দই লাগছে।’

কল গ্রহণ করার দিক দিয়ে এগিয়ে আছেন এমন চারজন চিকিৎসকের তথ্যও পাওয়া গেল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। ১ হাজার ৯৬৯ কল গ্রহণ করেছেন ডা. বিজয় কুমার দে, ১ হাজার ৭৩৭ কল গ্রহণকারী ডা. সোহেল রানা এবং ডা. মাহমুদুল হাসান ও ডা. আবদুল খালেক প্রত্যেকেই ১ হাজার ২০০-এর বেশি কল গ্রহণ করেছেন।

আক্রান্ত হয়েও থামেননি রেনেসাঁ

এপ্রিলের শুরুতে হঠাৎ কাশি আর হালকা গলাব্যথা অনুভব ক০রেন চিকিৎসক জুনিয়র তাহের রেনেসাঁ। করোনার উপসর্গ আঁচ করতে পেরে নমুনা পরীক্ষা করতে দেন। ১০ এপ্রিল জানতে পারেন, তিনি করোনায় আক্রান্ত।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর বাসার একটি ঘরে আইসোলেশনে চলে যান রেনেসাঁ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে থাকে তাঁর দিন। তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি, সেবা দিয়েছেন হটলাইনে যুক্ত হয়ে। রেনেসাঁ বললেন, ‘আমি মার্চেই অ্যাপে যুক্ত হই। নিজে আক্রান্ত হওয়ার পর ঘরেই যেহেতু থাকতাম, দায়িত্ববোধ থেকে দিনের একটা সময় সেবা দিতাম।’

নিজে আক্রান্ত ছিলেন বলেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনেক পরামর্শ দিতেন। বিশেষ করে আইসোলেশনে থাকার সময়টায় মানসিক সুস্থতার বিষয়টি। জুনিয়র তাহের রেনেসাঁ বলছিলেন, ‘একা একটি কক্ষে দিনের পর দিন আবদ্ধ থাকা ভীষণ কঠিন। বাসায় অনেকে আছে, কিন্তু কারও সঙ্গে দেখা করার উপায় নেই, এটা মনের ওপর প্রভাব ফেলে। আমি নিজেই ১৪তম দিনে মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করি।’ ৫ মে নমুনা পরীক্ষার পর জেনেছেন, জুনিয়র তাহের রেনেসাঁর করোনা নেগেটিভ। তাঁর করোনা দিনের অভিজ্ঞতার ভিডিও প্রচারিত হয়েছে এটুআইয়ের ফেসবুক পেজে। 

আবু তাহের আর জুনিয়র তাহের রেনেসাঁদের মতো নিবেদিতপ্রাণ এমন মানুষেরাই স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক হিসেবে এগিয়ে এসেছেন। ৩৩৩ হটলাইনের মাধ্যমে শঙ্কিত মানুষকে দিচ্ছেন চিকিৎসাসেবা, জোগাচ্ছেন মনের জোর। সাধুবাদ তো তাঁদেরই প্রাপ্য।