শেষ বিদায়ের সঙ্গী একজন রুকন

করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফনের প্রস্তুতি চলছে
করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফনের প্রস্তুতি চলছে

প্রশ্নটি হৃদয়বিদারক। তবু সাক্ষাৎকার পর্বের মাঝামাঝি সময়ে ব্যক্তি সম্পর্কে যখন অনেক কিছু জেনেছি, জেনেছি তাঁর সাম্প্রতিক দায়িত্ব সম্পর্কেও, তখনই জিজ্ঞেস করি, এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া কতজন মানুষের দাফন সম্পন্ন বা সৎকার করেছেন?

২৬ বছরের তরুণ মুফতি রুকন বিন মিসবাহর ত্বরিত উত্তরে একটু যেন হতচকিত হয়ে যাই। অনলাইনে জুমের মাধ্যমে ভিডিও কলে রুকুন বিন মিসবাহর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলে ওঠেন, ‘আমি দুই শতাধিক মানুষের খেদমত করতে পেরেছি। তাঁদের দাফনে সরাসরি অংশ নিয়েছি। যাঁদের মধ্যে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারকে সম্মান দেখানোর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে থাকবে।’

রুকনের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ। মাথায় সাদা টুপি। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের শেষ বিদায়ের কাজ করছেন। তাঁর দায়িত্বটা কষ্টের। রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। এ দায়িত্বই যেন খুশি মনে কাঁধে নিয়েছেন মুফতি রুকন। সে দায়িত্বের অংশ হিসেবেই জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে শেষ সম্মান দেখান তিনি ও তাঁর দল।

রুকন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আল-মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশের একজন কর্মী। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে সাড়া দেয় আল-মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ। শুরুর সময়ই মৃত ব্যক্তিদের শেষ বিদায়ের কাজে যুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। একজন অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ পাঁচজনের যে দল নিয়ে আল-মারকাজুল ইসলামী কাজ শুরু করেছিল, রুকন তাঁদের একজন। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে যখন দ্বিতীয় ব্যক্তি মারা গেলেন, তাঁকে দাফন খেদমত করার মাধ্যমে কাজ শুরু করি আমরা।’

মুফতি রুকন বিন মিসবাহ। ছবি: সংগৃহীত
মুফতি রুকন বিন মিসবাহ। ছবি: সংগৃহীত

নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন রুকন। প্রতিদিন দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যে প্রতিষ্ঠানগুলো সৎকারের কাজ করছে, আল-মারকাজুল ইসলামী তার একটি। মিসবাহ নিজে সৎকারে অংশ নেওয়া ছাড়াও তাঁর প্রতিষ্ঠানের হয়ে এ কাজে নিয়োজিত দলের দেখভাল করেন।

রুকন জানান, ‘দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাঁর। কখনো দেখেছেন বাবাকে ফেলে চলে গেছে সন্তানেরা, কোনো স্ত্রীকে হয়তো ফেলে গেছে স্বামী, আতঙ্কে মৃত ব্যক্তির পাশে আসেনি আত্মীয়স্বজন। তখন রুকনেরা গেছেন শেষ কাজটুকু সম্পন্ন করতে। তিনি বলেন, ‘আমরা সব ধর্মের মানুষের সৎকার করি। এখানে তার বড় পরিচয় সে মানুষ। হিন্দু ধর্মের হলে শ্মশান পর্যন্ত নেওয়ার কাজ আমরা করি, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা হয়তো সে ধর্মের কেউ করে থাকেন।’

প্রতিদিন দায়িত্ব পালন শেষে তাঁদের দলটি প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ করা বাসায় থাকছে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকটা একাকী সময় কাটান প্রত্যেকে। রাজধানীর মুগদাপাড়ায় বেড়ে ওঠা তাঁর। পরিবারে মা–বাবা-ভাইবোন আছেন। রাজধানীতে থেকেও দুই মাসের বেশি সময় হলো বাড়িতে যাননি। পবিরারের সদস্যরা নিয়মিত খোঁজ রাখেন তাঁর। রুকনের কাজে তাঁরা গর্বিত। রুকন বলেন, ‘যত দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিরুপায়ভাবে মানুষ প্রাণ হারাবে, তত দিন এই বেদনাদায়ক কাজটি করে যেতে চাই।’