অসহায়ের পাশে আলমগীর মেম্বার

ইউপি সদস্য এস এম আলমগীর হোসেন করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়েও খুলনার রূপসা উপজেলায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রোজ ৬০০ মানুষকে একবেলা খাইয়েছেন প্রায় এক মাস ধরে। রমজান মাসে সরবরাহ করেছেন ইফতার সামগ্রী, ঈদেও দিয়েছেন চিনি-সেমাই। এখন তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শতাধিক অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।

এস এম আলমগীর হোসেন। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
এস এম আলমগীর হোসেন। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

দুই বছর আগের কষ্টটা শিউলি বেগমের মনে এখনো জ্বলজ্বলে। সন্তানের মুখ দেখার জন্য মনটা কেবলই তৈরি হচ্ছিল। নিজের ভেতর আরেকটা মানুষের বেড়ে ওঠা মনে মনে যেন অনুভব করছিলেন শিউলি। কিন্তু কী থেকে কী হলো, গর্ভেই মারা গেল তিন মাসের বাচ্চা। পরে অবশ্য জানলেন কারণটা, পানিশূন্যতা।

শিউলি আবার সন্তান ধারণ করেছেন। বয়স এখন চার মাস। করোনার সময়ে সংশয় নিয়ে কথা বলছিলেন এক পুষ্টিবিদের সঙ্গে। শিউলি বেগমের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছিলেন পুষ্টিবিদ। টেলিমেডিসিন সেবায় পুষ্টিবিদদের সঙ্গে মুঠোফোনে এ কথা বলিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছেন এস এম আলমগীর হোসেন।

খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটী গ্রামের শতাধিক গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের তালিকা রয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য আলমগীর হোসেনের কাছে। করোনার সময় ঝুঁকি নিয়ে যাতে চিকিৎসকের কাছে যেতে না হয়, সে জন্যই তাঁর এই প্রচেষ্টা। প্রয়োজন অনুযায়ী হবু বা নতুন মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারও সরবরাহ করছেন তিনি।

তাই তো শিউলি বেগমের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সুর, ‘প্রথম বাচ্চা মারা যাওয়ার কারণে দ্বিতীয় বাচ্চা নিয়ে বেশ আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। এমন সময় আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছি। কোন সময় কী করতে হবে, কী খেতে হবে—তা ওই চিকিৎসক বলে দিয়েছেন।’

প্রায় এক মাস প্রতিদিন ৬০০ জনকে এক বেলা করে খাইয়েছেন এস এম আলমগীর হোসেন
প্রায় এক মাস প্রতিদিন ৬০০ জনকে এক বেলা করে খাইয়েছেন এস এম আলমগীর হোসেন

রোজ ৬০০ জনের হাসিমাখা মুখ

নৈহাটী গ্রামের অধিকাংশ নারী-পুরুষ মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কাজ করেন। কয়েকজন আছেন ছোট ব্যবসায়ী। সাধারণ এই খেটে খাওয়া মানুষদের সামনে দুর্দিন নেমে আসে গত মার্চ মাসের শেষ দিনগুলোতে। তখনই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় থেকে এই মানুষদের পাশে দাঁড়ান এস এম আলমগীর হোসেন। রোজ একবেলা খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেন নিজের চেষ্টায়।

৩০ মার্চ থেকেই রান্না করা খিচুড়ি প্যাকেট করে সন্ধ্যায় এলাকার প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসতেন। এভাবে প্রতিদিন ৬০০ মানুষের কাছে পৌঁছে যেত খাবার। আলমগীর হোসেনের ওই রান্না করা খাবারের কার্যক্রম চলে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতিদিন খরচ হতো ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে।

২৫ এপ্রিল রমজান মাস শুরু হওয়ার দুই দিন আগে রান্না করা খাবার সরবরাহ কাযক্রম বন্ধ করেন আলমগীর। এরপর ওই এলাকার এক হাজারের বেশি পরিবারের মধ্যে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করেন। ঈদের সময় বিতরণ করেন সেমাই-চিনি।

আলমগীর মেম্বার

৩৫ বছর বয়সী এস এম আলমগীর হোসেনের বাড়ি খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটী গ্রামে। তিনি নৈহাটী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। ছোট একটি মাছের ঘের আছে আলমগীরের। পাশাপাশি ক্লে টাইলসের ছোট একটি কারখানাও রয়েছে তাঁর। এসব জায়গা থেকে যে আয় হয়, তা সবই বিলিয়ে দেন মানুষের জন্য। এক ভাই ও মা-বাবার সংসারে তাঁর কোনো আর্থিক সহযোগিতা করার প্রয়োজন হয় না। এ কারণেই মানুষের জন্য তাঁর ‘পাগলামি’ যেন একটু বেশিই।

নৈহাটী গ্রামের সোহরাব হোসেন বলছিলেন, অনেকেই মনে করেন, আলমগীর হয়তো এলাকায় নিজের ভোটব্যাংক বাড়ানোর জন্যই এসব করছেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। আলমগীর হোসেনের এমন কাজ ইউপি সদস্য হওয়ার আগে থেকেই। এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা তাঁর সব সময়ই। তাঁর ওই কাযক্রম শুধু তাঁর নিজের ওয়ার্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। আশপাশের বিভিন্ন ওয়ার্ডের মানুষও তাঁর সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।

আলো ফুটবেই

২০১৮ সালের ৪ মার্চ ছুটির দিনের পাতায় আলমগীর হোসেনের ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘আলো ফুটবেই’। গ্রামের মানুষকে বই পড়ানোর মাধ্যমে সচেতন করার জন্য নিজেই ভ্যান চালিয়ে হাজির হন বাড়ি বাড়ি। ভ্যানটি তাঁর ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। তাঁর এই ভ্যানে থরে থরে সাজানো নানা রকম বই। সঙ্গে বাঁধানো খাতা, কাগজ, কলম, চকলেটের বয়াম। এগুলোর পাশাপাশি আছে নাগরিক সনদ, জন্মনিবন্ধনসহ নানা রকম আবেদন ফরম।

আলমগীর হোসেন একটি প্রতিবন্ধী স্কুল ও একটি প্রাক্‌–প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। প্রতিবন্ধী স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫০। অন্যদিকে প্রাক্‌–প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের খেলাধুলার মাধ্যমে পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে করোনার কারণে বর্তমানে দুই স্কুলের কাযক্রম বন্ধ।

নিজে পড়ালেখা করে খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারেননি আলমগীর। তিনি বললেন, ‘মাথায় নানা চিন্তা কাজ করে। এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি।’ আলমগীর নিজের উপার্জনে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন মানুষের জন্য। এ কাজে পরিবার থেকে তাঁকে কেউ বাধা দেন না, বরং তাঁরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

স্বেচ্ছাসেবকেরাও ভালোবাসেন

আলমগীর হোসেন তাঁর এসব কাজে সহযোগিতার জন্য গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবক দল। সংগঠনের নাম দিয়েছেন ‘আলো ফুটবেই’। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যায় প্রায় অর্ধশত। অধিকাংশই কলেজপড়ুয়া। তবে যুবকের সংখ্যাও কম নয়।

স্বেচ্ছাসেবকদের একজন মো. হাসিবুর রহমান। খুলনা আযম খান কমার্স কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। হাসিবুর বলেন, ‘ভালো লাগা থেকেই ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। আলো ফুটবেই সংগঠনটি এলাকার মানুষের জন্য যে ধরনের কাজ করে, তাতে সবাই উদ্বুদ্ধ হন।’

সংগঠনে কাজ করেন মিতা দে। নৈহাটী ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত সহকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি। পাশাপাশি সময় পেলেই সহযোগিতা করেন আলমগীর হোসেনের কাজের। করোনাকালীন গ্রাম আদালত বন্ধ থাকায় প্রায় দুই মাস সেখানে শ্রম দিয়েছেন। মিতা বলেন, এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছেন আলমগীর। এ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে ভালোই লাগে।

এভাবেই সবার ভালোবাসায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর।