সাজেকে আদনানের ১০০ দিন

>আদনান জুবাইদ রাঙামাটির সাজেক উপত্যকায় গেছেন মার্চের মাঝামাঝি সময়ে। ২৬ জুন সাজেকে তাঁর শততম দিন পূর্ণ হয়েছে। পাড়াপ্রধানের রিসোর্টে থাকছেন, পাহাড়ি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে নিজের রান্না নিজে করছেন, প্রায়ই স্থানীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে চলে যাচ্ছেন দুর্গম পাহাড়ে। তাঁর অভিজ্ঞতা শুনে লিখেছেন সজীব মিয়া
সাদা মেঘে ডুবে আছে সাজেক উপত্যকা। ছবি: আদনান জুবাইদ
সাদা মেঘে ডুবে আছে সাজেক উপত্যকা। ছবি: আদনান জুবাইদ

রাত ১০টায় সেখানে যে রীতিমতো গভীর রাত, সে তো আদনান জুবাইদের কথা বলার ধরনেই বুঝলাম। গভীর রাতে মানুষ যেমন নিচু স্বরে কথা বলে, রাতের নিস্তব্ধতাকে সম্মান জানিয়ে অট্টহাসি চেপে যায়, ঠিক সেভাবেই মুঠোফোনে কথা বলে গেলেন তিনি। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, রাত নয়টা বাজতেই এখন তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস।
অভ্যাসটা তো এমনিতে গড়ে ওঠেনি। রাঙামাটির সাজেকে সন্ধ্যা নামার আগেই স্থানীয়রা ঘরে ফেরেন। কোলাহলমুখর রিসোর্টগুলোতে করোনাকালে যেন রাজ্যের নীরবতা। মানুষ বলতে, এই পর্যটকবাড়ির ব্যবস্থাপনার জন্য হাতে গোনা জনাকয়েক। বিদ্যুৎ–সংযোগ পৌঁছায়নি বলে সৌরশক্তির বাতিতেই সান্ধ্য আলো জ্বলে মেঘপাহাড়ের সাজেকে। তারপর রাতের খাবার শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় কী! ওদিকে রাত বাড়তে থাকলে ঝিরির জল গড়ানোর শব্দও রাতের সঙ্গে মিতালি করে। সেই শব্দে গাঢ় ঘুমে ডুব দেন আদনান জুবাইদও।

জুমের কাজ শেষে ঘরে ফেরা
জুমের কাজ শেষে ঘরে ফেরা

‘ভোরে উঠে সকালটা আমি ছবি তুলে কাটাই। রাতেই ঠিক করে রাখি কোন দিকে যাব। ভোর হতেই মুঠোফোনটা নিয়ে ছুটি সেখানটাই। মেঘ আর সবুজ পাহাড়ের রূপটা মন ভরিয়ে দেয়।’ আদনান জুবাইদের দিনের শুরু এভাবেই। তারপর ঘরে ফিরে চায়ে চুমুক। সকাল আর দুপুরের জন্য উনুনে রান্না চড়ানো। গরম গরম খিচুড়ি কিংবা সবজি-ভাত পেট পুরে খেয়ে পা বাড়ান দুর্গম পাহাড়ে। তখন তিনি সঙ্গী স্থানীয় বাসিন্দাদের। কখনো তাঁদের মাছ ধরা দেখেন, ছবি তুলতে তুলতে নিজেও পাহাড়ি ঝরনা বা নদীতে নেমে যান অনেক সময়। দুপুরে ফিরে এক পেট খেয়ে বিকেল কাটান সাজেকের শিশুদের সঙ্গে। স্থানীয় লুসাই আর ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের শিশুদের সঙ্গে তাঁর সখ্যটাও মন্দ নয়।
এই রুটিনেই গতকাল ২৬ জুন সাজেক উপত্যকায় কেটেছে আদনানের শততম দিন। শুরুটা করেছিলেন ১৮ মার্চ। সাজেকে তো বাঙালিদের অনেকেই এখনো আছেন দায়িত্বের খাতিরে। কিন্তু আদনান ব্যক্তিগত কাজে খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক উপত্যকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। মার্চে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হতে থাকলে তিনি থেকে গেছেন সেখানেই। এখন ফেরার সুযোগ তৈরি হলেও মনটা যেন বাঁধা পড়েছে পাহাড়ের প্রকৃতিতে। তবু ফেরার সময়টা ঠিক করেছেন, ‘বর্ষাটা উপভোগ করছি। দিন দশেক পর হয়তো চলে আসব।’ বলেন আদনান।

আদনানের বলা জীবনবৃত্তান্ত থেকে জেনে যাই, তাঁর বাড়ি গাজীপুরে। মা-বাবা গত হয়েছেন, আছেন বড় ভাই। ২০০৬ সালে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন তিনি একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর মিরপুরে। গাজীপুরে বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দেওয়া। সে ভাড়া থেকে পাওয়া অর্থে আদনানের ঘোরাঘুরি মোটামুটি চলে যায়, তা তাঁর কথাতেই বোঝা গেল। তার ওপর নিজেও একটি রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী। জীবনের জটিল সমীকরণ মেলাতে চান না বলে পাহাড়-নদী-সমুদ্র তাঁর আপনজন।
আর এই যে এত দিন ধরে রিসোর্টে থাকছেন, সেখানকার খরচাপাতি? শুধরে দেন আদনান জুবাইদ, ‘এখানে যে স্থানীয় পাড়াপ্রধানের মেয়ের রিসোর্টে থাকছি, সেটা বিনে পয়সায়। খরচাপাতি বলতে চাল-ডাল-তরিতরকারি আর দিন দশেক পর পর এক ট্যাঙ্ক পানি।’
ব্যাগপ্যাকে তিনটি টি-শার্ট, দুটি জিনস আর এক পাটি জুতা নিয়ে বেড়িয়েছিলেন, এখনো পোশাক বলতে এ-ই। তবে জীবনটাকে জেনেছেন নতুনভাবে। জীবন মানে যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া, স্রোতের বাইরে ভালো লাগার পথে চলে, শহুরে বিলাসিতা আর কাঠিন্যের বাইরেও যে জীবনের নানা মাত্রা আছে, ১০০ দিনে আদনান তা বুঝেছেন যথেষ্ট। তাই তো আদনান জুনাইদ বলেন, ‘জীবনের এই সহজ নিয়মেই সামনের দিনগুলো কাটাতে চাই আমি।’

এখানেই কাটছে আদনান জুবাইদের দিন
এখানেই কাটছে আদনান জুবাইদের দিন

আদনানের কয়েকটি অভিজ্ঞতা
করোনা রুখতে কমিটি
করোনাভাইরাসের বিস্তার বাড়ার দিনগুলোতে পাড়াপ্রধানের নেতৃত্বে সাজেকে কমিটি করা হয়েছে। অনেকের জানা, সাজেকে প্রবেশ ও বেরিয়ে আসার পথ একটিই। সে পথ আটকে দেওয়া হয়েছে। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারটা স্থানীয়রা কঠোরভাবে মেনে চলছে। এখান থেকে কেউ গেলে যেতে হচ্ছে একেবারে।

সাজেক একটি নদীর নাম
সাজেক যে একটা নদীর নাম, এটা জানি এখানে আসার পর। এই নদীর নামেই ইউনিয়নের নামকরণ। সাজেক পর্যটনকেন্দ্র থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নদীটির অবস্থান। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে পর্যটকেরা সাধারণত সেখানে যেতে পারেন না। খালগোছের নদীতে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা জলের স্রোত আছে বেশ।

পানির অপর নাম জীবন
পানির মূল্য সাজেকে এসে বুঝেছি। স্থানীয়দের সবার ঘরেই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে। বর্ষায় একটু কম কষ্ট হলেও শুষ্ক মৌসুমে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। কাছের ঝিরি (ঝরনা) থেকে অনেক কষ্ট করে ব্যবহারের ও খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে স্থানীয়রা। এখানে এক ট্যাঙ্ক পানি ৮০০ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। আমিও খাওয়ার পানি ঝিরি থেকে তুলে আনি।

ঝুড়িভরা পাহাড়ি লিচু
ঝুড়িভরা পাহাড়ি লিচু

মেঘে মেঘে যায় বেলা
সাজেকে শীতকালে পর্যটক বেশি এলেও এখানকার মেঘের খেলা দেখা যায় আসলে বর্ষায়। এমনও দেখেছি মূল রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক পাশে ঝলমলে রোদ, অন্য পাশে ঝুম বৃষ্টি। হুটহাট এখানে–ওখানে রংধনুও দেখতে পাওয়া যায়।

বাঁশবৃত্তান্ত
বাঁশ যে কত কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, সেটা সাজেকে থেকে টের পেয়েছি। বাসস্থান, দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য ঝুড়ি, বসার আসন—এসব তো আছেই। চা, পানি পানের পাত্রও বাঁশের। ইদানীং সাজেকে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় বাঁশে করে চা পান, ব্যাম্বু-টি বলা হয় যেটাকে। একসময় রান্না করার পাত্র না থাকায় স্থানীয়দের সব রান্নাই বাঁশে করা হতো। এখনো অনেক পরিবার তা-ই করে।

ভরপেট দুবেলা
স্থানীয় মানুষদের খাদ্যাভ্যাসও লক্ষণীয়। সকালে ভরপেট খেয়ে জঙ্গলে চলে যায়, কেউ জুম চাষ করে, কেউ জঙ্গল থেকে কলাগাছের ভেতরের সাদা অংশ, কচু, বিভিন্ন শাক, কলা—এসব সংগ্রহ করে সন্ধ্যার আগে ফিরে আবার ভরপেট খায়। মাঝের সময়টুকু জঙ্গলে কিছু পেলে খায়, না হলে খায় না। মূলত দুবেলা খেয়ে এরা অভ্যস্ত। শুঁটকি দিয়ে তৈরি নাপ্পি এদের পছন্দের খাবার।

বাঁশে ভরেই রান্না হবে ঝিরি থেকে ধরা মাছগুলো
বাঁশে ভরেই রান্না হবে ঝিরি থেকে ধরা মাছগুলো

পড়ে থাকা ফলে সবার অধিকার
কেউ কারও গাছের ফল চুরি করে না। তবে গাছের নিচে পড়ে থাকলে খেতে মানা নেই। লিচু, আম, কাঁঠাল নিচে পড়ে থাকতে দেখেছি। একদিন দেখি, কে যেন আম খেয়ে আঁটিটা ঠিক গাছের তলায় রেখে গেছে। মনে মনে ভাবি, একটা সময় কতজনের কত গাছের ফলফলারিই না সাবাড় করেছি!

মধু হই হই
মাটির নিচ থেকে মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। সব সময় তো গাছ কিংবা ওপরের কোথায় মৌমাছির চাক দিতে দেখা যায়। পাহাড়ে দেখলাম, গাছের গোড়ার মাটির নিচেও মৌচাক। সেই মধু অতি ঘন।