সেই জীবন

তখন দুরন্ত শৈশব। বাড়ির পেছনের পুকুরটায় গোসলের ছলে দিনে একবার তো নামতামই, দ্বিতীয়বারের বেলায় বাধত বিপত্তি। মা রাজি হতেন না। আমিও নাছোড় বান্দা। ঘ্যানর ঘ্যানর করে, রাতে বেশি পড়ব বলে অনুমতি নিয়েই ছাড়তাম। মায়ের ‘হ্যাঁ’ বলতে দেরি হলেও পুকুরে লাফ দিতে আমার দেরি হতো না।

পুকুরপাড়ের ফজলি আমগাছটা থেকে আরও অনেকটা দূরে সরে এক দৌড়ে কে কত দূর লাফ দিতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা হতো। সমবয়সী চাচাতো বোনদের সঙ্গে ডুব খেলা, সাঁতার প্রতিযোগিতাসহ নানা উদ্ভট খেলা আবিষ্কার আর খেলা শেষে চোখ লাল করে উঠে আসতাম।

খেজুরের গুড় তৈরির জন্য ব্যবহৃত ড্রাম পুকুরে নামিয়ে নৌকা বানাতাম। সেটা ছিল সবচেয়ে মজার খেলা। শীতের শেষে গুড় করার পালা শেষ হলে ড্রাম চাতালে তোলার আগে যে কদিন পড়ে থাকত, সেই কদিনই আমাদের উৎসব লেগে যেত। দুই বোন দাদির কাছে ফিসফাস করে ড্রাম নামানোর বায়না করতাম। ছোট চাচা শুনতে পাওয়ার ভয়ে আমরা যতই ফিসফাস করে কাজ সারার চেষ্টা করি, দাদি ততই চেঁচিয়ে ওঠেন। পুরোপুরি রাজি হতেন না, তবে গলার স্বর একটু নেমে এলেই বুঝতাম, এখন নিয়ে যাওয়া যাবে।

একবার নিতে পারলেই ব্যস! একটা কঞ্চির বইঠা জোগাড় করে ড্রামের মাঝখানটায় বসে পুকুরের এ-মাথা ও-মাথা ঘোরা। সে যে কী আনন্দ! কেউ দেখে ফেললে ঘটত বিপত্তি। বাড়ির কলতলা থেকে তাকালে পুকুরটা দেখা যেত। বড় আব্বা অজু করতে কলতলায় এসে দেখে ফেললে চাপা স্বরে টেনে টেনে বলতেন, ‘এই তোদের মরার ফইর (পাখনা) উঠছে নাকি? চাবুক চিনিস? চাবুক?’

আমরা বাংলা সিনেমা থেকে চাবুক চিনেছি। বাস্তবে কখনো চাবুক দেখিনি। বড় আব্বারও চাবুক ছিল না। আমার ধারণা, তিনিও কখনো চাবুক দেখেননি। তবু আমরা চাবুকের ভয়ে উঠে আসতাম।

বাড়ির পাশে যে সিঁদুর আমগাছটা ছিল, বসন্ত এলেই তার সবচেয়ে নিচের ডালটায় বাঁধা হতো পাটের মোটা দড়ি। তারপর তাতে চড়ে, দে দোল।

শৈশবকে ‘সোনালি শৈশব’ নয়, বরং ডায়মন্ড, প্লাটিনাম বা এর চেয়েও অধিক কিছু বললেও যেন কম বলা হয়। সে জীবন মায়ার জীবন, না-ভোলা জীবন, অমূল্য জীবন। অবিরত সে জীবনের স্মৃতি আওড়াতেও যে ক্লান্তি আসে না।

রাজশাহী