সুন্দরবনে মধুর অভিযান

জোয়ারের সময় বনের ভেতরে প্রবেশ করেন মৌয়ালরা। খুঁজে বের করেন মৌচাক। কাঁচা-শুকানো পাতায় ‘কাড়ু’ বানিয়ে ধোঁয়া দেওয়া হয় চাকে। মৌমাছি সরে গেল মৌয়াল কাটেন চাক। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
জোয়ারের সময় বনের ভেতরে প্রবেশ করেন মৌয়ালরা। খুঁজে বের করেন মৌচাক। কাঁচা-শুকানো পাতায় ‘কাড়ু’ বানিয়ে ধোঁয়া দেওয়া হয় চাকে। মৌমাছি সরে গেল মৌয়াল কাটেন চাক। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

ছোট একটি ডিঙিনৌকায় আমরা ছয়জন। অনেকটা রোবটের মতো চুপচাপ বসে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ছয়জনের মধ্যে তিনজন মৌয়াল। তাঁরা নৌকা নিয়ে চলেছেন মৌচাকের সন্ধানে।

আমাদের যাত্রা শুরু হয় খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদী থেকে। এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের অনুমতি (পাস) দেয় বন বিভাগ, ওই কর্মকাণ্ড চলে জুন মাসের শেষ পর্যন্ত। হঠাৎ করেই সুযোগ হয় মৌয়ালদের সঙ্গে মধু সংগ্রহে যাওয়ার। বনজীবী মনিরুল ইসলাম, আবুল কালাম ও ইব্রাহিম হোসেনের সঙ্গী আমরা তিনজন।

মনিরুল ও আবুল কালাম মধু সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। ইব্রাহিমের অভিজ্ঞতা পাঁচ বছরের। তিনজনই বংশপরম্পরায় সুন্দরবনের মধু ও মাছ সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত।

মৌচাকের সন্ধানে

তিন বনজীবীর কথার ফাঁকে এগোতে থাকে নৌকা। বনের মধ্যের ছোট খাল দিয়ে এঁকেবেঁকে নৌকাটি চলে যায় গেড়া নদীতে। আগে থেকে একটি মৌচাক দেখে রেখেছিলেন মৌয়াল দলের সদস্যরা।

ঘণ্টাখানেক নৌকা চলার পর গন্তব্যস্থলে পৌঁছাই। তখন জোয়ারের পানি বাড়ছে। বনের ভেতরে প্রায় এক হাত পানি আর পানির নিচে শ্বাসমূল। শ্বাসমূল যেন পায়ে না ফুটে যায়, তাই বনে পা ফেলার আগে বিশেষ প্লাস্টিকের জুতা পরে নেন বনজীবীরা। আমাদের জুতা না থাকায় খালি পায়েই নেমে পড়ি। এক পা ফেলতেই বোঝা যায় খালি পায়ে বনে হাঁটার বিড়ম্বনা।

আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান মনিরুল। তখনো আমরা বেশ খানিকটা দূরে। এরই মধ্যে কালামের কাছ থেকে সংকেত পাওয়া গেল, মৌচাক রয়েছে। মনিরুলের সহায়তায় আরও একটু সামনে এগিয়ে দেখা যায় কালাম ও ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই কিছুটা দূর থেকে আঙুল উঁচিয়ে দেখান মৌচাকটি। চোখের সামনে মৌচাকের দেখা মিলতেই উবে গেল পায়ে শ্বাসমূল আর গায়ে গাছের খোঁচা খাওয়ার ব্যথা। কাছে গিয়ে মুঠোফোনে ছবি তোলার চেষ্টা করতেই মৌয়ালরা ইশারা করলেন বেশি কাছে যাওয়া যাবে না। যদি একবার মৌমাছি কিছু বুঝতে পারে, তাহলে তাদের আক্রমণে চাক না কেটেই এলাকা ছাড়তে হবে।

মধু সংগ্রহের পালা

তিন মৌয়াল তখন চাকে ধোঁয়া দেওয়ার জন্য দক্ষ হাতে শুরু করলেন ‘কাড়ু’ তৈরির কাজ। হুদো নামের একধরনের লম্বাটে শুকনা ঘাসজাতীয় গাছ আর তার চারপাশে কাঁচা গোলপাতা দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হলো সেটি। ঠিক হলো, মনিরুজ্জামান ও আমি যাব চাক কাঁটতে।

মৌমাছি যেন হুল ফুটিয়ে দিতে না পারে, এ জন্য একটু মোটা ট্রাউজার পরে নিলাম আমরা। মাথায় পরিয়ে দেওয়া হলো বিশেষ জাল। কাড়ুতে আগুন দিতেই ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে গেল এলাকা। এরপর সেটি নিয়ে সামনে সামনে চললেন মনিরুল। তাঁর কাঁধের সঙ্গে ঝোলানো মুখের উপরিভাগ কাটা একটি নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রাম, তার মধ্যে রয়েছে একটি দা। ড্রামটি ঝুলিয়ে নেওয়ার সুবিধার জন্য দুই পাশে চারটি ফুটো করে দড়ি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্বাসমূল সামলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। বেশ কিছুটা দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে অন্যরা। মৌচাকের ঠিক নিচে যেতেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো কাড়ু। সেটির জ্বলন্ত মুখ নিচের দিকে ধরলে ধোঁয়ার মাত্রা বেশি হয়। আমাকে সেটি বুঝিয়ে দিয়েই গাছে উঠে গেলেন মনিরুল। ততক্ষণে ধোঁয়ার আঁচ পৌঁছে গেছে মৌচাকে, উড়তে শুরু করেছে মৌমাছি। আমাকে ঘিরে ধরল একঝাঁক।

চাক থেকে মৌমাছি সরে যেতেই মধুসমৃদ্ধ চাক ফুটে উঠে চোখের সামনে। পুরো চাকের চার ভাগের মাত্র এক ভাগে রয়েছে মধু। দা দিয়ে সে অংশ কাটতেই মধুসমেত চাকটি পড়ে ড্রামের মধ্যে। আর এ কাজ করতে করতেই কাড়ু ধরে থাকা হাতে হুল ফুটিয়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তিনটি মৌমাছি। গাছ থেকে নেমে পড়তেই ড্রাম আর কাড়ু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাই আমরা।

তখন আমাদের পিছু নিয়েছে শত শত মৌমাছি। তাড়া খেয়ে খালি পায়ে মাটিতে থাকা খাড়া খাড়া শ্বাসমূল মাড়িয়ে ছুটতে থাকি নৌকার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকায় পৌঁছে যাই। ততক্ষণে হুল ফোটানো স্থানে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। হয়তো হুল ফোটানোর পরই যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল, কিন্তু মধু সংগ্রহের উচ্ছ্বাসে তা টের পাইনি।

নৌকায় উঠেই হাল ধরে দ্বিতীয় মৌচাকের দিকে চলতে শুরু করেন মৌয়ালেরা। ড্রামের মধ্যে তাকিয়ে চাকসহ টাটকা মধু দেখেই মনটা জুড়িয়ে যায়। নৌকা চলতে শুরু করলেই নিজ হাতে চাকের কিছু অংশ কেটে মুখে পুরি। মধুতে ভরে যায় মুখ। আহা কী তৃপ্তি!