করোনাকালে মানুষের পাশে

>মানবিক কাজে যুক্ত আছে মাস্তুল ফাউন্ডেশন। করোনাকালে সেই কাজ এগিয়ে নিতে একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনতে সহায়তা করেছে ক্রিকেটের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ফাউন্ডেশন। মাস্তুল মূলত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিশুদের স্কুলমুখী করে, পাশে থাকে। তরুণ সংগঠক কাজী রিয়াজ রহমানের গড়া মাস্তুলের আছে সামাজিক আরও উদ্যোগ।

১. অসহায় মানুষদের নিত্যপণ্য বিতরণ

১. সাকিবের ফেসবুক পেজে মাস্তুল নিয়ে পোস্ট

৩. মাস্তুলের নতুন অ্যাম্বুলেন্স

৪. শিশুরা পড়ছে মাস্তুলের স্কুলে

হাঁটতে শিখতে গেলে একটু-আধটু হোঁচট খেতে হয়। কাজী রিয়াজ রহমানের সংগঠন গড়ার অভিজ্ঞতা অনেকটা হাঁটতে শেখার মতো। তবে হোঁচটকে শিক্ষা হিসেবে মানেন বলেই সংগঠনের হাল ধরেছেন দৃঢ়তায়, এগিয়ে যেতে সাহসের পাল তুলেছেন মাস্তুলে। তবে তাঁর মাস্তুল শুধু নৌকা বা প্রাচীনকালের জাহাজে পাল খাটানোর বড় খুঁটি নয়, সংগঠন। সরকারি খাতায় যার নাম ‘মাস্তুল ফাউন্ডেশন’।

‘আমরা নিজেদের পরিচয় দিই “মাস্তুলিয়ান” বলে’—এভাবেই কথা শুরু হলো কাজী রিয়াজ রহমানের সঙ্গে। শৈশবে যারা পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের স্কুলমুখী করেন মাস্তুলিয়ানরা। রাজধানীতে দুটি স্কুল পরিচালনা করছে মাস্তুল। যেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ছে ২৫০ শিক্ষার্থী। বিভিন্ন জেলায় আরও ২২টি স্কুলের হাজারখানেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর হাতে নিয়মিত পৌঁছে দেয় শিক্ষা উপকরণ। মানুষকে স্বাবলম্বী করাসহ মাস্তুলের সামাজিক আরও নানা উদ্যোগ আছে।

করোনার সময় মানুষকে সহযোগিতার বিষয়টিও যোগ হয়েছে অন্যান্য উদ্যোগের সঙ্গে। ৮ জুলাই কথা হচ্ছিল কাজী রিয়াজ রহমানের সঙ্গে। রায়েরবাজারে মাস্তুল কার্যালয় থেকে মুঠোফোনে এই তরুণ শোনালেন করোনার উদ্যোগসহ এগিয়ে যাওয়ার কথা। তিনি বললেন, ‘করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলে স্কুলসহ শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়। সরকার ছুটি ঘোষণা করলে আমাদের শিক্ষার্থীদের দরিদ্র পরিবারগুলো সংকটে পড়ে। প্রথমে তাদের খাদ্যসহায়তা করি আমরা।’

এপ্রিল থেকে ঢাকার অসহায় পরিবারের পাশাপাশি সহায়তা চাওয়া অনেক নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছে দেন মাস্তুলের স্বেচ্ছাসেবীরা। যে সহায়তায় থাকে চাল-ডাল-আলু-তেলসহ একটি পরিবারের চার থেকে সাত দিনে চলার মতো নিত্যপণ্য। সেই সঙ্গে সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধির মতো কাজও করেছে। এরপর করোনা রোগীদের বিনা মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা শুরু করতে ভাড়া নেন অ্যাম্বুলেন্স। বাসা থেকে হাসপাতালে আনা-নেওয়া জন্য তখন অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া ছিল ঝক্কির কাজ। তখন অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু করে মাস্তুল।

কাজী রিয়াজ রহমান বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন, এমন একজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের কাজ শুরু হয়।’

সাকিবের সহায়তা

মাস্তুলের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স নেই বলে, প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার টাকা ভাড়ায় নিতে হতো। নিজেদের তহবিল আর বিত্তবানদের কাছে পাওয়া অনুদানের একটি অংশ চলে যেত অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকায়। তাই একটি অ্যাম্বুলেন্স কেনার চেষ্টা করছিলেন তখন থেকেই। ‘আমরা কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সহায়তার আবেদন করেছিলাম।’ বলেন কাজী রিয়াজ রহমান।

সেই আবেদনের বার্তাটি পৌঁছেছিল বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের কাছেও। ৬ জুলাই তাঁর ফেসবুক পেজে বিষয়টি নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ছবিসহ একটি পোস্টও করা হয়। কাজী রিয়াজ রহমান জানান, তাঁদের প্রস্তাব সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা ব্যারিস্টার চিশতি ইকবাল সাকিব আল হাসানের নজরে আনলে তিনি সহায়তা করার সম্মতি দেন। সাকিবের পেজেও বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবায় সহায়তা করবে সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন ও মাস্তুল ফাউন্ডেশন।

কাজী রিয়াজ বলেন, ‘মানুষের সহায়তা নিয়ে আমরা এরই মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছি। হাসপাতালে আনা-নেওয়াসহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ২৪ জন মানুষের দাফন করিয়েছি। এই কাজ চলমান। অ্যাম্বুলেন্স আমাদের কাজকে সহজ করল। অ্যাম্বুলেন্স কিনতে সহায়তার জন্য সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন ও বিদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’

মাস্তুলের শুরু পথের ধারে

২০১৩ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে সবে ভর্তি হয়েছেন কাজী রিয়াজ রহমান। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় বাংলাদেশ স্কাউট ও রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবী কাজের প্রতি তাঁর মনটা গড়ে উঠেছে তখনই। তাই নিজেদের মতো করে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলে কয়েক বন্ধু ভেবেছিলেন একটা সংগঠন গড়ার কথা। ইচ্ছাটা পোক্ত, তবে পরিকল্পনা তখনো ভাসা-ভাসা। রিয়াজের বাসা ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায়। তত দিনে কয়েকজন মিলে ধানমন্ডি লেকের পাশে সহায়-সম্বলহীন কিছু শিশুকে পাঠদান শুরু করেছেন। নিজেদের হাত খরচ বাঁচিয়ে এই শিশুদের বই-খাতা-কলম কিনে দিতেন।

দিনে দিনে অনেক স্বেচ্ছাসেবী যুক্ত হন মাস্তুলের সঙ্গে। শিশুদের পড়ানোর সঙ্গে শুরু করেন স্বেচ্ছায় রক্তদান। শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র, বন্যার্তদের সহায়তা, গাছের চারা রোপণের মতো কাজ। কাজী রিয়াজ বলেন, ২০১৬ সালে রায়েরবাজারে স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাস্তুলের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

লক্ষ্য বড় হলো

স্কুল প্রতিষ্ঠার পর লক্ষ্য বড় হতে থাকল কাজী রিয়াজ রহমানের। ‘স্পনসর আ চাইল্ড’ কর্মসূচির মাধ্যমে পরিচিত মানুষের অর্থসহায়তায় চলছিল স্কুলের কার্যক্রম। একসময় স্কুলশিক্ষার্থীদের পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে হাতে নিলেন ‘স্বাবলম্বী’ প্রকল্প। রিয়াজ বলেন, ‘এরই মধ্যে রিকশা, ভ্যান, সেলাই মেশিন কিনে দেওয়াসহ নানাভাবে ৭০ জন মানুষকে আমরা স্বাবলম্বী করেছি।’

তবে মনে-মগজে মাস্তুল গেঁথে গেছে দেখে কাজী রিয়াজ রহমানকে নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না তাঁর মা-বাবার। রিয়াজের ব্যবসায়ী বাবা এখন অবশ্য রিয়াজকে অনুপ্রেরণা জোগান। তিন ভাইবোনের মধ্যে রিয়াজ বড় বলেই দায়িত্বটাও বেশি। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। চাকরি করবেন না ঠিক করেছেন। রিয়াজ বলছিলেন, ‘আমার নিজের একটি রেস্তোরাঁ আছে। মাস্তুলের বুটিক শপ আছে। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে থাকি। এসব থেকে প্রাপ্ত অর্থ মাস্তুলের কাজে বড় ভূমিকা রাখে।’

এ ছাড়া মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অনুদানসহ বড় কর্মসূচির ক্ষেত্রে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডসহ অনেক প্রতিষ্ঠানকেও পাশে পেয়েছেন বলে জানালেন রিয়াজ। তাই তো ২০১৯ সালে ‘মাস্তুল শেল্টার হোম’ গড়ে তুলেছেন, যেখানে ২২টি অনাথ শিশু থাকছে। মাস্তুলের স্কুলে পড়ছে। কাজী রিয়াজের স্বপ্ন এই শিশুদের সমাজের মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করার।

সবকিছুর পরও নিজেদের প্রধান লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি মাস্তুল। ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার কাজ সব সময় করে যাবেন। আর মানবিক কাজ তো চলতেই থাকবে।