আমার দুই নবাব

>

সত্যিকারের গল্প

হাটে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর পোষা গরুটিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল অর্থী। ৩১ জুলাই ছবিটি ছাপা হয় প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়। তা দেখে অনেকেই অর্থীকে সাহায্য করতে চান। এইচএসবিসি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী মো. মাহবুবুর রহমান যোগাযোগ করেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তাঁরই আর্থিক সহযোগিতায় ৩ আগস্ট অর্থীকে নতুন গরু কিনে দেওয়া হয়। বড় নবাবের স্মৃতি এবং নতুন নবাবকে পেয়ে কেমন লাগছে, সেসবই লিখে জানিয়েছে অর্থী

হাটে প্রিয় ‘নবাব’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল অর্থি। এখন অবশ্য ওর মুখে হাসি ফুটেছে।  প্রথম আলোর মাধ্যমে একটি গরু পেয়ে খুশিতে নাম রেখেছে ‘ছোট নবাব’। ছবি: রাফিদ ইয়াসার
হাটে প্রিয় ‘নবাব’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল অর্থি। এখন অবশ্য ওর মুখে হাসি ফুটেছে। প্রথম আলোর মাধ্যমে একটি গরু পেয়ে খুশিতে নাম রেখেছে ‘ছোট নবাব’। ছবি: রাফিদ ইয়াসার

এক বছর আগে আমার বাবা ঘোড়াধাপ হাট থেকে একটা লাল টুকটুকে গরু নিয়ে এল। আমি দৌড়ে গরুটা দেখতে গেলাম। বাবা একটা গাছের সঙ্গে ওকে বাঁধল। আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে ওর মাথায়–কানে হাত বোলালাম আমি। ও তখন মাথাটা নিচু করে আমার দিকে তাকাল। আমি ওর গলাটা আমার বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম। গরমে ও ঘামছিল। তাই ওর চার পা স্যাভলন–পানি দিয়ে ধুয়ে, ঘরে বেঁধে ফ্যান চালু করে দিলাম। ফ্যানের বাতাস পেয়ে হাত–পা ছেড়ে দিয়ে নবাবের মতো আরাম করে শুয়ে পড়ল ও। তা–ই দেখে ওর নাম দিলাম নবাব।

শুরু হলো নবাবকে নিয়ে আমার ব্যস্ততা। পরদিন সকালে বাবা ওকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এল গোসল করানোর জন্য। আমি শ্যাম্পু দিয়ে ওর গা ঘষে দিলাম আর বাবা ওর গায়ে পানি ঢালল। এভাবে প্রতিদিনই ওকে গোসল করাতাম। গোসলের পর গামছা দিয়ে ওর গা মুছে দিতাম। তখন ওর মাথাটা আমার মুখে লাগাত। আমি বুঝতাম, ও আমাকে আদর করল; ও আমার বন্ধু হবে। তখন থেকে ও আমার বন্ধু হলো। এরপর মায়ের সঙ্গে খাবার তৈরি করে ওর সামনে দিতাম। আমি সামনে না থাকলে ঠিকমতো খেত না। ওর খাওয়া শেষ হলে আমি নিজে খেয়ে স্কুলে যেতাম। যাওয়ার সময় ওকে একটা চুমু দিয়ে যেতাম।

স্কুলে গিয়েও সব সময় নবাবের কথা মনে পড়ত। ছুটি হলেই বাসায় এসে বই না রেখে আগে ওর সামনে দাঁড়াতাম। ও মাথা দিয়ে আমাকে ডাকত, আমি তখন ওর কাছে গিয়ে একটা চুমু দিতাম। চিরুনি দিয়ে ওর শরীর আঁচড়ে দিতাম। নবাব তখন আরামে ওর মাথাটা আমার গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকত। 

এভাবে নবাবের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হচ্ছিল। আমি বই নিয়ে ওর ঘরের সামনে পড়তে বসতাম। ও আমাকে দেখত, আমি ওকে দেখতাম। এ নিয়ে মা আমাকে বকাও দিত। নবাবের জ্বর–সর্দি হলে আমি ওর শিঙে তেল দিয়ে দিতাম, নাক–মুখ মুছে দিতাম। ওর সুস্থতার জন্য দোয়া করতাম। এভাবে কেটে গেল একটি বছর। আমার বন্ধু নবাব বড় হয়ে গেল।

হাটে বিক্রির সময় প্রিয় গরুকে জড়িয়ে ধরে অর্থির কান্নার এই ছবি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়। ছবিটি তুলেছিলেন রাফিদ ইয়াসার
হাটে বিক্রির সময় প্রিয় গরুকে জড়িয়ে ধরে অর্থির কান্নার এই ছবি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়। ছবিটি তুলেছিলেন রাফিদ ইয়াসার

ঈদুল আজহার সময় এগিয়ে এল। নবাবকে হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুঁটি পুঁততে গেলাম বাবার সঙ্গে। খুঁটি দেখে আমার কান্না পেয়ে গেল। মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসে দেখি নবাবের চোখ দিয়েও পানি পড়ছে। ও বুঝতে পেরেছিল বন্ধুকে ছেড়ে যেতে হবে। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখ মুছে দিলাম। বিক্রির আগের সারা রাত আমি নবাবের ঘরের দরজার সামনে শুয়ে ছিলাম। পরদিন দুপুরে ওকে হাটে নিয়ে যায় বাবা। আমি না খেয়ে সারা দিন কাঁদছিলাম।

শেষমেশ নবাবকে দেখার জন্য দাদার পেছন পেছন হাটে যাই আমি। হাটে গিয়ে আমার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিলাম। পরে জেনেছি, সেই ছবি এক আঙ্কেল তুলেছিলেন। একসময় নবাব বিক্রি হয়ে গেল। আমার কান্না থামাতে নবাবকে আবার সাত দিনের জন্য বাসায় আনা হলো। ঈদের আগের দিন সকালে ওকে নিতে এল। আমার বুকের মধ্যে কী কষ্ট যে হচ্ছিল, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। অনেক কষ্টে বিদায় দিলাম আমার বন্ধু নবাবকে।

মন খারাপ করে ঘরে বসে ছিলাম। এমন সময় আমার মামা সেদিনের প্রথম আলো পত্রিকা নিয়ে এল। দেখি, সেই আঙ্কেলের তোলা নবাব আর আমার ছবিটি ছাপা হয়েছে। সবাই অনেক আনন্দ করছিল। আমি শুধু পত্রিকায় নবাবকে দেখছিলাম। আমার তখনো খুব কষ্ট হচ্ছিল। বাবা আমাকে বলল নতুন নবাব কিনে দেবে। পরদিন ঈদ। এদিকে সারা দেশের মানুষ নবাব ও আমার বন্ধুত্বের কথা জেনে গেছে। সবাই জেনেছে আমার মন খারাপের কথা। কিন্তু বেশি দিন আমার মন আর খারাপ থাকল না।

নবাবের জন্য আমার মন খারাপ দেখে প্রথম আলো পত্রিকার আঙ্কেলরা আমাকে একটা সুন্দর ছোট নবাব উপহার দিলেন। ছোট নবাবকে পেয়ে আমি অনেক খুশি। বড় নবাবের মতো আদর–যত্ন করে ছোট নবাবকে আমি বড় করে তুলব। আশা করি ছোট নবাবও আমার ভালো বন্ধু হবে। 

অর্থী 

তৃতীয় শ্রেণি, হাজরাদিঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বগুড়া