উঁচু হিল পুরুষের ফ্যাশন ছিল!

১৭ শতকে ব্যবহৃত পুরুষদের জুতা
১৭ শতকে ব্যবহৃত পুরুষদের জুতা
চতুর্দশ লুইয়ের প্রতিকৃতিতে তাঁকে উঁচু হিল পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়
চতুর্দশ লুইয়ের প্রতিকৃতিতে তাঁকে উঁচু হিল পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়

নারীর ফ্যাশন হিসেবে গোড়ালি উঁচু (হাই হিল) জুতার প্রচলন রয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পুরুষেরাও এককালে হাই হিল জুতা পায়ে দিত।
নারীদের সাজসজ্জার উপাদান হিসেবে হাই হিল যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, এ জুতা মোটেও আরামদায়ক নয়। উঁচু হিলের একনিষ্ঠ অনুরাগীরাও এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য। স্বচ্ছন্দ চলাফেরা বা ভ্রমণে প্রতিবন্ধক উঁচু হিল বিভিন্ন জিনিসে আটকে যায়। ঘাস, বরফ, চকচকে ও মসৃণ মেঝে এবং পাথরে বাঁধানো রাস্তায় উঁচু হিল পায়ে চলাফেরা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সব মিলিয়ে মনে হয়, হাঁটাচলার জন্য এটি তৈরি করা হয়নি। আসলেই তাই! ইতিহাস ঘেঁটে সে তথ্যই পাওয়া যায়।
কানাডার টরন্টোয় অবস্থিত জুতার জাদুঘর বাটা সু মিউজিয়ামের কিউরেটর এলিজাবেথ সেমেলহ্যাক বলেন, প্রাচ্যের কাছাকাছি অঞ্চলজুড়ে কয়েক শ বছর ধরে উঁচু হিলের প্রচলন ছিল। পারস্যে (ইরান) অশ্বারোহী যোদ্ধা পুরুষের পরিচ্ছদ ছিল উঁচু হিল। ঘোড়ার পিঠে পা রাখার স্থানে (রেকাব) দাঁড়িয়ে ধনুক থেকে তির নিক্ষেপকালে যোদ্ধার শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করত তার জুতার হাই হিল।
১৫৯৯ সালের দিকে ইউরোপের অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকজন ইরানি ফ্যাশনের জুতা ব্যবহার করতে শুরু করে। নিজেদের আরও পৌরুষদীপ্তভাবে প্রকাশ করতেই তারা বেছে নেয় উঁচু হিল। তখন এই জুতাই ছিল পৌরুষ প্রকাশের মাধ্যম। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের প্রতিকৃতিতে (১৭০১ সালে ইয়াসান্থ রিগোর আঁকা) তাঁকে উঁচু হিল পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। পরবর্তী কালে সমাজের সাধারণ মানুষদের মধ্যেও উঁচু হিলের প্রচলন শুরু হয়। অভিজাতরা তখন নিজেদের জুতায় হিলের উচ্চতা নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়। তবে সপ্তদশ শতকে ইউরোপের রাস্তাঘাট যে রকম কর্দমাক্ত ও এবড়োখেবড়ো ছিল, তাতে উঁচু হিলের উপযোগিতা একদমই ছিল না। সেমেলহ্যাক বলেন, তখনকার যুগে সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের মানুষকে কাজ করতে হতো না এবং না হাঁটলেও চলত। তাই বাস্তবতাবিবর্জিত, অদ্ভুত, অস্বস্তিকর ও ব্যয়বহুল পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশ করত।
জুতার সুবিশাল সংগ্রহের জন্য খ্যাত ইমেলদা মার্কোসের মতোই তখনকার যুগে চতুর্দশ লুইয়ের খ্যাতি ছিল। উচ্চতায় তিনি ছিলেন পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। নিজেকে আরও লম্বা দেখাতেই তিনি চার ইঞ্চি উঁচু হিল ব্যবহার করতেন। সেই যুগে হিল এবং জুতার তলিতে সামরিক চিহ্ন হিসেবে লাল রং ব্যবহৃত হতো। সেই রং করার প্রক্রিয়াটি ছিল ব্যয়বহুল। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের অভিষেককালীন প্রতিকৃতিতে (১৬৬১ সালে আঁকা) তাঁর পায়ে ফরাসি ফ্যাশনের লাল হাই হিল দেখা যায়। অবশ্য তিনি ছয় ফুট লম্বা ছিলেন।
১৬৭০-এর দশকে চতুর্দশ লুই কেবল তাঁর রাজসভার সদস্যদের লাল হাই হিল পরার বৈধতা দিয়ে একটি ফরমান জারি করেন। তবে এতে অনুমোদনবিহীন ও নকল হিলের প্রচলন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সেমেলহ্যাক বলেন, একপর্যায়ে পুরষের পোশাক-পরিচ্ছদের বিভিন্ন উপাদান নারীর ফ্যাশনেও অন্তভুর্ক্ত হতে শুরু করে। ১৬৩০-এর দশকে নারীরা ছোট ছাঁটের চুল এবং সেনাদের আদলে কাঁধের অলংকার ও পুরুষালি হ্যাট ব্যবহার এবং পাইপে ধূমপান শুরু করেন। এভাবেই তাঁরা হাই হিলও ব্যবহার শুরু করেন।
লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর হেলেন পারসন বলেন, সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে পরিস্থিতি আবার পাল্টাতে শুরু করে। তখন হিলের ধরনে পরিবর্তন আসে। পুরুষেরা বর্গাকার, শক্ত ও নিচু হিল এবং নারীরা চিকন ও বাঁকা হিল পরতে শুরু করে।
নারীবাদী শিলা জেফ্রিস মনে করেন, পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেয়েদের যন্ত্রণা দিতে এবং দ্রুত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতেই তাদের পায়ে হাই হিল পরিয়েছে।
পুরুষদের ফ্যাশনে কাজের উপযোগী, সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পায়। তারা অলংকার বর্জন করে এবং পোশাকে সামাজিক বিভেদের চিহ্নও দূর হতে থাকে। হাইটস অব ফ্যাশন: আ হিস্ট্রি অব দি এলিভেটেড সু বইয়ের রচয়িতা সেমেলহ্যাক বলেন, এনলাইটেনমেন্টের প্রভাবে পুরুষদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও নারীদের সাধারণত আবেগপ্রবণ, ভাবপ্রবণ ও শিক্ষালাভের অনুপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মূলত কোনো কারণ ছাড়াই তাদের পরিচ্ছদের অংশ হয়ে পড়ে হাই হিল। ১৭৪০ সালে পুরুষেরা এ ধরনের জুতা ব্যবহার পুরোপুরি ছেড়ে দেয়। তবে মাত্র ৫০ বছর পর ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে নারীরাও হাই হিল বর্জন করে। কিন্তু নারীদের ফটোগ্রাফির প্রচলন শুরুর মধ্য দিয়ে উনিশ শতকে হাই হিলের ফ্যাশনটি ফিরে আসে।
আশিস আচার্য
তথ্যসূত্র: বিবিসি অনলাইন ও উইকিপিডিয়া।