প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা

এ বছরের ২৮ জুলাই পালিত হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মতো এ যুদ্ধের উত্তাপ ঢাকাকেও আলোড়িত করেছিল। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গঠিত একমাত্র বেঙ্গলি রেজিমেেন্ট কী ছিল ঢাকার ভূমিকা? লিখেছেন মুহাম্মদ লুৎফুল হক

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা

১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই। শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ৪ আগস্ট এ যুদ্ধে যোগ দিল ইংল্যান্ড। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১২ লাখ সেনা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন যুদ্ধের বিভিন্ন রণাঙ্গনে। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে অংশ নেন আরও কয়েক লাখ ভারতীয়। তবে এ যুদ্ধে কতটা অবদান ছিল ঢাকার, বাঙালি সেনাদের?

বেঙ্গলি রেজিমেন্টের মনোগ্রাম
বেঙ্গলি রেজিমেন্টের মনোগ্রাম

প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে সেনাবাহিনীতে বাঙালির উপস্থিতি ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু চমকপ্রদ তথ্য হলো, এ যুদ্ধের মাধ্যমেই বাঙালিরা নতুনভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১৬ সালের ৭ আগস্ট গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ঢাকা শহরে বাঙালিদের জন্য একটি পদাতিক রেজিমেন্ট বা পল্টন গঠনের ঘোষণা দিলেন। এই রেজিমেন্টই পরে পরিচিতি পেল ‘৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’ বা ‘বাঙালি পল্টন’ হিসেবে। নওশেরা ও করাচিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মেসোপটেমিয়া ও কুর্দিস্তানের রণাঙ্গনে যোগ দেয় দলটি। সেটা একটু পরের ঘটনা।

নবাব হাবিবুল্লাহ
নবাব হাবিবুল্লাহ

তবে বেঙ্গলি রেজিমেন্ট গঠনের সরকারি সিদ্ধান্তের আগেই কলকাতায় গড়ে ওঠে একটি বেসরকারি সংগঠন—‘বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটি’। সে সময় বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ মাহতাব, ডা. এস কে মল্লিকসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা যুক্ত ছিলেন এর সঙ্গে। এই কমিটির প্রধান কাজ ছিল রেজিমেন্ট গঠনে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ ও সাধারণ মানুষকে এর স্বপক্ষে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করা।
ঢাকায় পল্টনের জন্য সেনা সংগ্রহের প্রাথমিক দায়িত্ব দেওয়া হলো আর কে দাস ও শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে। পরে বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটির ঢাকা শাখা গঠিত হলে জেলা কালেক্টর এস জি হার্ট সভাপতি, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক ও গৌরনিতাই শঙ্খনিধি কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগদানে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ঢাকায় প্রথম জনসভাটি হয় ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে। ঢাকা করোনেশন পার্কে অনুষ্ঠিত এ সভায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকলেও সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ। সভায় ঢাকার তরুণদের রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি।
বেঙ্গলি রেজিমেন্টে সেনা ভর্তির জন্য সরকারকে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ঢাকা শহরে দুটি বেসরকারি ভর্তি কেন্দ্রের ঘোষণাও এল সভা থেকে—একটি শ্রীশচন্দ্র চ্যাটার্জি ও অন্যটি হাকিম হাবীবুর রহমানের বাসায়।
২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা সেনানিবাসে সরকারিভাবে শুরু হলো সেনা ভর্তির কাজ। ১৯ অক্টোবর বাঙালি পল্টনে যোগ দিতে ঢাকা থেকে কলকাতায় রওনা হলো প্রথম দলটি। কেমন ছিল সেই ক্ষণ?
কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইংলিশম্যান-এ লেখা আছে সেই বিবরণ: সকাল সাড়ে এগারোটায় বার লাইব্রেরিতে দলটিকে দেওয়া হলো বিদায় সংবর্ধনা। তারপর বাদকদল ও মিছিলসহকারে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো রেলস্টেশনে। চারদিকে তখন জনতার মুহুর্মুহু স্লোগান—‘আল্লাহু আকবর’, ‘বন্দে মাতারাম’।
১৯১৭-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সদরঘাটে মুসলমানদের এক সভায় নবাব হাবিবুল্লাহ দিলেন বাঙালি পল্টনে যোগদানের ঘোষণা। ২৬ এপ্রিল পল্টনে যোগদানের জন্য করাচির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তিনি। ওই দিন বিকেলে বার অ্যাসোসিয়েশন হলে তাঁকে জানানো হলো জাঁকজমকপূর্ণ বিদায় সম্ভাষণ।
এ সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সেনা সংগ্রহের জন্য নিয়মিত সভা হতে থাকে। প্রত্যেক সভাতেই তরুণেরা আসতে থাকেন পল্টনে যোগ দেওয়ার জন্য। তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে এ সভাগুলোতে স্থানীয় ব্যক্তিরা ছাড়াও কলকাতা থেকে আসতেন অনেকে—স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, সম্পাদক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. এস কে মল্লিক প্রমুখ।
প্রথম দিকে ঢাকার সেনারা রেজিমেন্টে যোগ দিতেন কলকাতা হয়ে। কলকাতা মহিলা সমিতি বিদায়কালে সেনাদের কিছু উপহারসামগ্রী প্রদান করত। ১৯১৭ সালের শুরু থেকে ঢাকায় নির্বাচিত সেনারা রেজিমেন্টে যোগ দিতে সরাসরি করাচি চলে যেতে শুরু করেন। ফলে দুরূহ হয়ে পড়ে সেনাদের উপহার প্রদান। এ সমস্যা দূর করতে ঢাকা শহরের বিশিষ্ট নারীরা ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশনে সেনাদের সাহায্যার্থে ‘মহিলা সমিতি’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন। দিনটি ছিল ১৯১৭-এর ৩ জুন।
১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। প্রথম মহাযুদ্ধের বিবদমান দু-পক্ষ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল। ফলে ঢাকাসহ সব ডিপোতে বন্ধ হয়ে গেল সেনা ভর্তি কার্যক্রম। ২৭ নভেম্বর সারা ঢাকায় ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হলো বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি। ২৯ নভেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে হলো আনন্দ উৎসব। এ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ। শহরের অন্যান্য স্থানেও সে সময় আনন্দ উৎসব হয়, রাতে শহরকে সাজানো হয় বর্ণিল আলোকসজ্জায়।

ঢাকায় গৌরনিতাই শঙ্খনিধির বাড়িতে বেঙ্গলি রেজিমেন্টের সৈনিকেরা, ১৯১৭
ঢাকায় গৌরনিতাই শঙ্খনিধির বাড়িতে বেঙ্গলি রেজিমেন্টের সৈনিকেরা, ১৯১৭

শুধু কি তাই, যুদ্ধ শেষের আনন্দে ৩০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গার পাড়ে আয়োজন করা হয় কাঙালি ভোজ। রাতে আলোকসজ্জায় উচ্ছল হয়ে ওঠে আহসান মঞ্জিল।
২৭ ডিসেম্বর বিকেলে নবাব হাবিবুল্লাহ রেজিমেন্ট থেকে ফিরে এলেন ঢাকায়। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ রেলস্টেশনে উপস্থিত হয়ে পতাকা নাড়িয়ে বাজনা বাজিয়ে সেদিন বরণ করেছিলেন নবাবকে। উচ্ছ্বসিত তরুণেরা গাড়ি থেকে ঘোড়া সরিয়ে নিজেরাই নবাবের গাড়ি টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আহসান মঞ্জিল পর্যন্ত।
১৯২০ সালের ৩০ আগস্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয় বেঙ্গলি রেজিমেন্ট।

বেঙ্গলি রেজিমেন্টের টুকিটাকি
বেঙ্গলি রেজিমেন্টে অবিভক্ত বাংলা থেকে সর্বমোট পাঁচ হাজার ৯৫২ জন যোদ্ধা ও ২৩১ জন ফলোয়ার্স যোগ দিয়েছিলেন, এর মধ্যে ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশিসংখক তরুণ। এঁদের সংখ্যা ছিল ৬৭৩ জন।
রোগ-শোকসহ অন্যান্য কারণে বেঙ্গলি রেজিমেন্টের ৬৩ জন সেনা মেসোপটেমিয়ায় মারা যান। এঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার সিপাই আবদুর রহমান, সিপাই জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি, সিপাই কামাক্ষ্যা দে, সিপাই রাধিকা মোহন দে, সিপাই সত্য নারায়ণ বোস, সিপাই শ্যামলাল ভট্টাচার্য ও সিপাই সুরেশচন্দ্র বোস।
অন্যদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধে বিভিন্নভাবে সরকারকে সহযোগিতার জন্য ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ ‘দি অর্ডার অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ খেতাব লাভ করেন। ঢাকায় সেনা ভর্তিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সরকার প্রতিভা নাগ, সরসীবালা চৌধুরানী, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গৌরনিতাই শঙ্খনিধি, খান সাহেব মোহাম্মদ হাফিজ, সারদা প্রসাদ রায় ও রাধাচরণ পোদ্দারকে সনদ প্রদান করে।