জলছবি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

টেবিলের ওপর একটা কাচের গ্লাসে অর্ধেক পানিতে একটা ফুলসুদ্ধ রজনীগন্ধার ডাঁটা রাখা। মিলন একবার ডাঁটাটি হাতে নিচ্ছে, আবার রাখছে। সন্ধ্যায় ফুলের দোকান থেকে কিনে এনেছে। ওর এ এক অদ্ভুত খেয়াল—যতবারই জান্নাতের সঙ্গে দেখা হয়, ততবারই একটি ফুল হাতে ধরে সামনে দাঁড়ায়। এখন ঘড়ির কাঁটা রাত দুইটার ঘরে। মিলনের চোখে ঘুম নেই। অস্থিরতা ওকে ঘুমোতে দিচ্ছে না। আবার মোবাইলে সে সময় দেখল এবং অস্থিরতার মাত্রা বাড়ল। সে এখন ভোরের অপেক্ষা করছে। শেষরাতের দিকে মিলন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার মস্তিষ্ক তাকে সকাল সাতটার দিকে জাগিয়ে দিল। বুক ধক করে উঠল তার। আজ জান্নাত আসছে, জান্নাত আসছে...।
নিজেকে পরিপাটি করে তুলতে ১০ মিনিটের বেশি সময় নিল না। আয়নায় নিজেকে একবার দেখল। তার চোখে-মুখে একচিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। তার সমস্ত মন-প্রাণ যেন খুশির আভায় নেচে উঠতে চাইছে।
বাসা থেকে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে এল মিলন। মনে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে। সেটা চাপা দিতেই সে জান্নাতকে ফোন দিল। কিন্তু জান্নাত ফোন রিসিভ করল না। সময় সকাল আটটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। গতকাল জান্নাত ফোনে বলেছিল, সকাল আটটার দিকে ওদের বাড়ি থেকে রওয়ানা দেবে। তার মানে ১১টার আগে ও পৌঁছে যাবে।
সকাল ১০টার দিকে মিলনের বাস গন্তব্যে পৌঁছে গেল। বাস থেকে নেমে পল্টন ঘাটে অপেক্ষা করতে লাগল মিলন। জান্নাত জানে না মিলনের আজকের পাগলামির কথা। আগে থেকে জানালে কিছুতেই মিলনকে এ পাগলামির সুযোগ দিত না। জান্নাতকে চমকে দিতে চায় মিলন। গত এক সপ্তাহ মিলনের সময় যে কীভাবে কেটেছে, তা কি জান্নাত একবারও ভেবেছে? ছাই ভেবেছে, মিলন বলে। ভাবলে কি ওকে ফেলে গ্রামে ঈদ করতে যেত। মিলনের অভিমান আকাশ ছোঁয়। এ সময় দমকা বাতাস মিলনের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যায়। মিলন এবার নিজের মাথায় নিজে চাটি মেরে বলে, ছুটিতে সবাই গ্রামে ঈদ করতে যাবে না তো কোথায় যাবে? তার মতো তো আর সবার আবাস শহরে নয়। আপন মনে এবার একগাল হাসল সে। পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে দেখে, জান্নাত তাকে কল দিয়েছে চারবার। আহা রে, মেয়েটা রেগে গেছে হয়তো! চটজলদি কল দিল সে। অপর প্রান্তে রিসিভ হলো, হ্যালো, হ্যালো...শোনো, আমি রওনা দিয়েছি। আজই ফিরছি...এত শব্দ...আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
মোবাইলের নেটওয়ার্ক এত খারাপ না যে লাইনটা কেটে যাবে, তবু গেল। অদ্ভুত! বিরক্তি প্রকাশ করল মিলন। আবারও কল দিল। কিন্তু রিসিভ হলো না। মিলনের মোবাইলে টেক্সট টোন বেজে উঠল। জান্নাতের টেক্সট। লিখেছে, ‘ফেসবুকে আসো। এখনই একটা ছবি পোষ্ট দিয়েছি—আমার ‘জলছবি’। তুমি নাকি কত দিন আমাকে দেখো না।’ ফেসুবক খুলে মিলন ভীষণ অবাক হলো, পাগলিটার কাণ্ড দেখো, খোলা বাতাসে চুলগুলোর অবস্থা কী করেছে! এই ছবি দেখে কে না বলবে, আসল পাগলি একটা! চারপাশে এত ভিড়ের মধ্যে...পারেও বটে মেয়েটা...হা হা হা!
আবারও কল দিল মিলন কিন্তু রিসিভ হলো না অপর প্রান্ত থেকে। কিন্তু মিলনের ভাগ্য প্রসন্ন হলো মিনিট তিনেক সময় পর, দ্বিতীয়বারের মতো টেক্সট টোন বেজে উঠল, ‘মিলু, এত মানুষের ভিড়ের মধ্যে কথা বলতে পারছি না, আর কিছু সময় পরই ঘাটে পৌঁছে যাব। তারপর তোমাকে কল দেব। আর বিকেলে তো আমাদের দেখা হচ্ছে...প্লিজ অস্থির হয়ো না।’ মিলনের চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি সামনে মেলে দিল। যত দূর চোখের দৃষ্টি দেওয়া যায় দিল সে। তবু সময় যেন কাটে না, সামিনা চৌধুরীর গানের মতো অবস্থা এখন মিলনের। সে সময় মিলনের আনন্দমিশ্রিত অস্থির সময়কে আড়াল করে চারপাশ থেকে মানুষের চিত্কার ভেসে এল। মিলন ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেয় না, সে দূরে চোখ মেলে তাকিয়েই আছে পলক না ফেলা চোখে। একসময় আরও শত মানুষের চোখের মতো তার চোখও দৃশ্যটা দেখল। দেখল এবং তার বুক মুহূর্তের জন্য অবশ হয়ে গেল। মোবাইলের টেক্সট টোনের আওয়াজে সংবিৎ এল তার। আবারও জান্নাতের টেক্সট, ‘মিলু, আমাদের লঞ্চটা ডুবে যাচ্ছে, তোমার জান্নাত ডুবে যাচ্ছে...’