সাতক্ষীরায় কিছুই হয়নি!

গাছ কেটে পথ অবরোধ। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি
গাছ কেটে পথ অবরোধ। ছবি: কল্যাণ ব্যানার্জি

সাতক্ষীরায় যাতায়াত ২০০৫ সাল থেকে। কখনো জলাবদ্ধতার কবলে থাকা বিপন্ন মানুষ, কখনো বা ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় বিধ্বস্ত বিপন্ন জনপদের খবর সংগ্রহ করাই ছিল উদ্দেশ্য। এ বছরের ৪ জানুয়ারি বার্তা বিভাগ থেকে সাতক্ষীরায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। বিষয়, নির্বাচনের খবর সংগ্রহের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক হামলার চিত্র তুলে আনা। মাস খানেক আগে থেকেই জাতীয় সংসদ বর্জনের ডাক দিয়ে লাগাতার অবরোধ ও সহিংসতা চালাচ্ছিলেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকে সারা দেশ থেকে সাতক্ষীরা এক রকম বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছিল বলা যায়।
আতঙ্কের জনপদ সাতক্ষীরার উদ্দেশে রওনা দিয়ে যখন যশোর বিমানবন্দরে পৌঁছালাম, তখন ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁই ছঁুই। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে বেশির ভাগ যাত্রী যশোর শহরের উদ্দেশে রওনা হলেন। একে একে বিমানবন্দর এলাকা ফাঁকা হয়ে গেলে অগত্যা উপায় না দেখে একটা মোটরসাইকেলে চেপে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দিকে রওনা হলাম।
যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা পুলেরহাট বাজারে আসতেই বিপত্তির শুরু। বাজারসংলগ্ন প্রধান সড়ক বন্ধ করে অবরোধকারীদের স্লোগান দিতে দেখা গেল, ‘যারা করে নির্বাচন, তাদের ঠেকাতে করো আন্দোলন।’ মোটরসাইকেলে এই পথ ধরে এগোতেই অবরোধকারীরা চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলল। লাঠি হাতে তেড়ে এল কয়েকজন। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই আরও ক্ষিপ্ত হলো তারা। নেতাগোছের একজন এসে পরিচয়পত্র দেখতে চাইলেন। পরিচয়পত্র দেখালে বললেন, ‘আচ্ছা সরকারের দালালি কইরতে আইসচো। দেশে-বিদেশের মানুষরে দেখাতি আসছ, সুন্দর ইলেকশন হচ্ছে।’
অবরোধকারীরা মোটরসাইকেল ভাঙার চেষ্টা করলে অনেক অনুনয়-বিনয় করে তা রক্ষা করা গেল। একজন অবরোধকারী বলল, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যদি লিখিস তো খবর আছে।’ মোটরসাইকেল বন্ধ করে হেঁটে যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যেতে বলল অবরোধকারীরা। অগত্যা হেঁটে, রিকশা আর ভ্যানে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তালায় পৌঁছালাম। পথে পথে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির বিরুদ্ধে অপরাধের সাক্ষী ফেলে রাখা অসংখ্য গাছের কাটা গুঁড়ি সহিংসতার ধরন সম্পর্কে ধারণা দিল।
সড়কের পাশে পুড়ে কালচে হওয়া ব্যানার ঝুলতে দেখা গেল। ১৪ দলের প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মোস্তফা লুৎফুল্লাহ আর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সরদার মুজিবের পোস্টার-ব্যানারের একই অবস্থা। তবে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের পর যেসব সংখ্যালঘু পরিবারের লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন, তাঁরা তখনো ফিরতে পারেননি। ভোটের উৎসব তাই এখানে আতঙ্কই নিয়ে এসেছিল।
নির্বাচনের দিন সকালে ভোট দেখতে বের হলাম। তিন-চারটি কেন্দ্রে ভোট দেখার পর দুপুর ১২টার দিকে মুঠোফোনে খবর এল, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ইসলামকাঠি ইউনিয়নের বেশির ভাগ কেন্দ্রের পাশে জড়ো হচ্ছেন। তাঁরা চারটি কেন্দ্রে যাওয়ার সড়ক বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছ ফেলে আটকে অবরোধ সৃষ্টি করেছেন। ডাঙ্গা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র দখল করে সেখানে ধারালো অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন জামায়াতের কর্মীরা।
এই খবর শোনার পর বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জানালে তাঁরা তা গুরুত্ব না দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। উল্টো বললেন, কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সবাই শান্তিমতো ভোট দিচ্ছেন। নির্বাচনী কর্মকর্তারা যখন এসব কথা বলছেন, তখন আবারও মুঠোফোনে ডাঙ্গা কেন্দ্র থেকে খবর এল, ভোট দিতে আসা একজন বৃদ্ধাকে জামায়াতের কর্মীরা তুলে নিয়ে গেছেন। ভোটকেন্দ্রে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাড়া না পেয়ে আরেকজন স্থানীয় সাংবাদিককে নিয়ে ইসলামকাঠি ইউনিয়নের পথে রওনা হলাম। বেলা তখন একটা। সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে চারটি কেন্দ্র অতিক্রম করলাম। বেশির ভাগ কেন্দ্র ফাঁকা। রাস্তায়ও কোনো লোকজন চোখে পড়ল না। দু-একজন পথচারী চোখ-মুখে আতঙ্ক নিয়ে নিরাপদ স্থানে ছুটে যাচ্ছেন। কেন্দ্রে যেতেই আমাদের দেখে কয়েকজন অবরোধকারী তেড়ে এল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমরা পিছু হটলাম। ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষার পর বিজিবি ও পুলিশের দুটি গাড়ি এসে ২০টি ফাঁকা গুলি ছুড়ল। অবরোধকারীদের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হলো। শেষ পর্যন্ত অবরোধকারীরা পিছু হটল।
পরদিনের প্রথম আলোতে ডাঙ্গা ইউনিয়নের অবরোধ ও সংঘাতের সংবাদসহ নির্বাচন বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলো। সকালে কল্যাণ ব্যানার্জির কাছে সাতক্ষীরার জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে বলা হলো, ‘এ ধরনের কোনো অবরোধ ইসলামকাঠিতে হয়নি। সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। সবাই ঠিকমতো ভোট দিয়েছেন। আপনার পত্রিকায় সঠিক সংবাদ আসেনি।’ উত্তরে কল্যাণ ব্যানার্জি বললেন, ‘আমাদের প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যা ঘটেছে তা-ই তিনি লিখেছেন।’
ইফতেখার মাহমুদ: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক