দৃষ্টিহারা ছেলেটির খবর

.
.

১৮ আগস্ট! বিকেলে অফিসে (প্রথম আলোর কুষ্টিয়া অফিস) বসে কাজ করছি। হঠাৎ দৌলতপুর উপজেলা থেকে শরিফুল ইসলাম নামের পরিচিত একজনের ফোন। বললেন, ‘ভাই, একটা খবর লেখা যেতে পারে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী খবর?’
শরিফুল জানালেন, তাঁর এলাকায় একটা ছেলে আছে, চোখে দেখে না। দরিদ্র পরিবারের ছেলে। এবার এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বললাম, ‘অদম্য মেধাবী হতে পারে।’ পরক্ষণেই তিনি বললেন, ‘ভাই, এর গল্পটা একটু আলাদা। ছেলেটির মা রাত জেগে মুঠোফোনে পড়া রেকর্ড করে দেন। আর সেটা শুনে আত্মস্থ করে ছেলেটি।’
চমকপ্রদ মনে হলো বিষয়টি। ঢাকা অফিসের সহকর্মী আবুল হাসনাত ভাইকে ফোন দিলাম। তাঁর পরামর্শে খবরটা যত দূর পারলাম লিখে পাঠালাম। ইতিমধ্যে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। হাসনাত ভাই লেখাটা পেয়ে বললেন, ‘বিষয়টা দারুণ। এটা নিয়ে ভালো কিছু করতে হবে। সকালে তোমার সঙ্গে কথা হবে।’
পরের দিন দুপুর ১২টায় হাসনাত ভাইয়ের ফোন। বললেন, ‘তোমাকে শাহেদ ভাই (বার্তা সম্পাদক) ফোন দেবেন। সেইমতো কাজ কোরো।’ মিনিট দশেক পরেই শাহেদ ভাইয়ের ফোন, ‘তৌহিদী, তুমি ওই ছেলেটার বাড়িতে যাও। তার মা-বাবা আর স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি আরও কথা বলো। বিস্তারিত লিখে পাঠাও আর অনেকগুলো ছবি পাঠাবে। আজকেই লেখাটা যাবে। যাও, বেরিয়ে পড়ো।’
কথা শেষ করেই মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলাম দৌলতপুরে সেই প্রত্যন্ত গ্রাম গোবরগাড়ায়। কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটারের রাস্তা। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, ছেলেটি মায়ের সঙ্গে কুষ্টিয়া শহরে কোচিংয়ের জন্য গেছে। কী আর করা! ছেলের বাবার সঙ্গে কথা বলে, মুঠোফোন নম্বর নিয়ে আবার কুষ্টিয়া ফিরে এলাম। শহরের পেয়ারাতলায় ছেলেটিকে খুঁজে পেতে বেশি সমস্যা হলো না। ততক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে। অগত্যা বৃষ্টি মাথায় করেই হাজির হলাম ছেলেটি যে বাসায় উঠেছে, সেখানে। তখন বেলা সাড়ে তিনটা। ঘণ্টা খানেক কথা হলো আবদুল্লাহ আল শাইম ও তাঁর মা চায়না খাতুনের সঙ্গে। ছেলেটি একবার শুনেই পড়া আত্মস্থ করে ফেলে। মুঠোফোনে রেকর্ড করা পড়া শুনলাম। সেই ছোট্টটি থেকেই আবদুল্লাহর চোখের আলো একটু একটু করে নিভে আসছিল। কলেজ অবধি এসে দৃষ্টিশূন্য হয়ে পড়ে সে। ফেরার আগে বেশ কিছু ছবি তুললাম মা-ছেলের। বিকেলে অফিসে ফিরে আগের দিন পাঠানো প্রতিবেদনটার ওপর খানিকটা কাটাছেঁড়া করলাম। এরই মধ্যে ছেলেটির কলেজশিক্ষকসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। ছবি ও প্রতিবেদন পাঠালাম ঢাকা অফিসে। যত্ন নিয়ে প্রতিবেদনটি সম্পাদনা করলেন সাঈদ ভাই।
পরের দিন সকাল ছয়টায় মুঠোফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙল। ফোন ধরতেই, ‘ভাই, ছেলেটার নম্বরটা একটু দেবেন?’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন ছেলে?’ অন্য প্রান্ত থেকে ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ প্রথম আলোতে যে প্রতিবেদন বের হয়েছে, সেই ছেলেটির।’ একের পর এক ফোন আসছে তো আসছেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন আসার পরিমাণও বাড়তে লাগল। দেশ-বিদেশ থেকে। অদম্য মা আর তাঁর মেধাবী ছেলের খোঁজ নিলেন। কেউ কেউ আবেগতাড়িত হলেন, চোখের পানি ফেললেন। অনেকে আর্থিক সহায়তা দিলেন। দাঁড়ালেন মা-ছেলের পাশে।
কদিন আগেই আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন, উত্তীর্ণও হয়েছেন।
তৌহিদী হাসান: কুষ্টিয়া প্রতিনিধি