দুঃসময়কে সুসময়ে পরিণত করা সম্ভব

ছবি: এম জসীম উদ্দীন
ছবি: এম জসীম উদ্দীন

হেমন্তের নরম বিকেলের মায়াবী রোদে বৃক্ষশোভিত আদিবাসী গ্রামটি যেন নির্জনতায় মুড়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের কোলে শুয়ে থাকা বরগুনার তালতলী উপজেলা সদর থেকে পূর্ব দিকে পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতেই মূল রাস্তা থেকে সরু আরেকটা পথ দক্ষিণ দিকে গিয়ে গহিনে মিলিয়ে গেছে। এগিয়ে যেতেই দুই পাশে সারি সারি টংঘর। নিচে খুঁটি পুঁতে সুতা ছড়িয়ে রেখেছে তাঁতিরা। ভেতরের আরেকটা ছোট গলি ধরে নির্জনতা ছাপিয়ে একদল আদিবাসী শিশু বই-খাতা হাতে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। 
ওরা আমার স্কুলের ছাত্রছাত্রী। আগাঠাকুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিকেলে শিশুরা দল বেঁধে পড়তে আসে। অবসর সময়ে স্বেচ্ছাশ্রমে এই শিশুদের মারমা (রাখাইনদের মাতৃভাষা) ভাষা শেখাই, গ্রামের আদিবাসী-বাঙালি নারীদের সমবেত করে যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পয়োনিষ্কাশন, কন্যাশিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করি। সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ি গ্রামে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করি। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় সহায়তার জন্য আমি ও আমাদের দুই শিক্ষক সহকর্মীকে নিয়ে গড়ে তুলেছি একটি সহায়তা তহবিল। এই তহবিলে প্রতি মাসে নিজেদের বেতনের একটা অংশ জমা করে তিলে তিলে একে সমৃদ্ধ করেছি। ২২ জন আদিবাসী দরিদ্র শিক্ষার্থীকে এরই মধ্যে আর্থিক সহায়তা দিয়ে উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে নিয়েছি। বিলুপ্তপ্রায় রাখাইন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমি গঠন করেছি আট সদস্যের একটি সাংস্কৃতিক দল। এই দলের মাধ্যমে রাখাইন সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা করে যাচ্ছি।
স্বেচ্ছায় পাঠদান
আমি যখন জোরে জোরে মারমা ভাষায় রচিত শিশুতোষ ছড়া—নিয়াখালা- ত্যা ত্যা, কজচা মাল্লা, না মল্লা অর্থাৎ ‘চল, জোছনা রাতে, ঘরের বাইরে’—উচ্চারণ করি শিশুরাও আমার সঙ্গে গলা মেলায়। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে খসখস করে যখন রাখাইন বর্ণমালা লিখে শিশুদের জিজ্ঞেস করি এটা কী? তখন ওরা বর্ণমালাগুলো আমাকে মুখস্থ বলে দেয়। কখনো ভাবি আমি হারিয়ে গেলেও এই শিশুদের মুখে মুখে বেঁচে থাকবে আমাদের মাতৃভাষা! আগে তালতলীর ১৩টি রাখাইন গ্রামে একটি করে রাখাইন ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। কিন্তু অনেক বছর তা বন্ধ। বিদ্যালয়ে রাখাইন শিশুরা বাংলা ভাষা শেখে। এতে এই শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় নিরক্ষরই থেকে যাচ্ছে। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে তিন বছর আগে ছোট পরিসরে কাজটি শুরু করি। গ্রামের চার-পাঁচজন শিশুকে নিয়ে শুরুর পর আস্তে আস্তে তা বেড়ে ৩২ জনে ঠেকেছে। সপ্তাহে চার দিন নিজের কর্মস্থল ছুটির পর এই কাজটি করি।
যেভাবে শুরু
ছোটবেলায় বাবা বলতেন, নিজে ভালো থাকাই আসল ভালো থাকা নয়, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে পারাটাই জীবনের আসল সার্থকতা। বাবার কথাগুলো তখন খটকা লাগত। একজন মানুষের সামর্থ্য আর কতটুকুইবা। এ দিয়ে সবাইকে নিয়ে কীভাবে ভালো থাকা যায়! এখন বুঝি সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে আর্থিক সামর্থ্যের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন মনের সামর্থ্য।
২০০২ সালের পড়াশোনা শেষ করে ডানিডার মৎস্য প্রকল্পে চাকরি নিই। সেই সুবাদে ২০০৩ সালে একটি প্রশিক্ষণে থাইল্যান্ড যাই। ১৬ দিন সেখানে অবস্থান করে আমার চোখ খুলে যায়। দেখি, সেখানকার প্রতিটি নাগরিক সপ্তাহে অন্তত চার ঘণ্টা সামাজিক নানা কাজে স্বেচ্ছায় শ্রম দেয়। সেখানের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে খুব ছোট আর অসহায় লাগছিল। এটা আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। দেশে ফিরে ভাবতে থাকি কীভাবে শুরু করা যায়। ওই সময় ছুটিতে বাড়িতে এলে গ্রামের নারীদের মৎস্য ও সবজি আবাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। দেখি নারীরা বেশ সাড়া দিচ্ছে। বেশ কয়েকজন রাখাইন তরুণীকে আধুনিক প্রযুক্তির তাঁত বোনার কাজে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। কিন্তু তা ছিল অনিয়মিত। এটা করতে হলে সার্বক্ষণিক এলাকায় থাকা প্রয়োজন। এ জন্য ২০০৪ সালে চাকরি ছেড়ে ওই বছরই তালতলী ডিগ্রি কলেজে যোগ দিই।
২০০৫ সালের গোড়ার দিকে গ্রামের ৩৫ জন তরুণ-তরুণী বাছাই করে তাঁদের নিয়ে ‘আগাঠাকুরপাড়া যুব উন্নয়ন সমিতি’ নামের একটি সমিতি করি। আমাকে এই সমিতির সভাপতি করা হয়। সদস্যদের মধ্যে ৫০ টাকা মাসিক চাঁদা দিয়ে আমরা শুরু করি স্বেচ্ছাশ্রমে আনুষ্ঠানিক পথচলা। গ্রামের অনেকে তখন আমাকে নানাভাবে এই কাজে নিরুৎসাহিত করে। অনেকে বলে, মেয়েমানুষ বিয়ে করে ঘরসংসার করবে, তার আবার সংগঠন করার দরকার কী! কিন্তু এসব গায়ে মাখিনি। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে একই গ্রামের এন তেন মংয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর উৎসাহ আমাকে আরও শক্তি জোগায়। তিন বছর সংগঠনটির কার্যক্রম ভালো চলার পর নানা বিষয়ে সংগঠনের অনেক সদস্য এলাকা থেকে অন্যত্র চলে গেলে সমস্যায় পড়ে যাই। তবু হাল ছাড়িনি।

শিক্ষা সহায়তা তহবিল
মানুষের সঙ্গে মিশে বুঝতে পারি, আসলে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন নেই। একটু ভালো ব্যবহার, সাহস এবং সীমিত সহায়তা পেলে তারা অনেক দূর যেতে পারে। এই চিন্তা থেকে ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে আমার সম্প্রদায়ের দুই সহকর্মী সহকারী অধ্যাপক চা মে ও মংলাচের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠনের ব্যাপারে আলাপ করি। তাঁরা রাজি হন। এরপর সিদ্ধান্ত নিই মাসিক বেতন থেকে প্রত্যেকে একটা অংশ জমা করব। সে অনুযায়ী এটা আমরা শুরু করি।

কন্যাশিশুদের স্কুলে পাঠানো
ছোটবেলা থেকে একটি বিষয় আমাকে খুব কষ্ট দিত। তা হলো মেয়েদের প্রতি পরিবার ও সমাজের বঞ্চনা। আমাদের গ্রামে মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ করতেন বাবা-মায়েরা। অনেকে মেয়েশিক্ষাকে ধর্ম ও সামাজিকতা পরিপন্থীও বলতেন। অভিভাবকেরাও মেয়েদের বোঝা মনে করতেন। তাই ১২-১৩ বছর হলেই বিয়ে দেওয়া হতো। মেয়েদের বিয়ে মানে বাবা-মায়ের ঘাড়ের বোঝা নেমে যাওয়া। বালবিবাহের শিকার বেশির ভাগ মেয়েকে যৌতুকের জন্য স্বামী নির্যাতন করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিত। বাবার পরিবারে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় বেড়ে উঠে স্বামীর সংসারেও জুটত সীমাহীন লাঞ্ছনা আর অমর্যাদায়। ছোটবেলা থেকেই এটাকে অন্যায় মনে হয়েছে আমার। আমি বুঝতে পারি মেয়েদের এই বঞ্চনার কবল থেকে বের করতে হলে প্রথমেই তাকে শিক্ষিত হতে হবে। উৎপাদনের হাল হবে। এ জন্য প্রথমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কন্যাশিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করি। বাবা-মায়েদের বোঝাই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে নিচু নয় কিংবা তারা বোঝাও নয়। সুযোগ পেলে তারা একটি পরিবারের নেতৃত্ব দিতে পারে। বোঝাই অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার অপকারিতা। নিজের তাগিদে গ্রামে ঘুরে যৌতুক নেওয়া-দেওয়া যে একটা সামাজিক অপরাধ, সে সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করি।
আমাদের গ্রামে মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ করতেন বাবা-মায়েরা। অনেকে মেয়েশিক্ষাকে ধর্ম ও সামাজিকতা পরিপন্থীও বলতেন। অভিভাবকেরাও মেয়েদের বোঝা মনে করতেন। তাই ১২-১৩ বছর হলেই বিয়ে দেওয়া হতো। মেয়েদের বিয়ে মানে বাবা-মায়ের ঘাড়ের বোঝা নেমে যাওয়া। বালবিবাহের শিকার বেশির ভাগ মেয়েকে যৌতুকের জন্য স্বামী নির্যাতন করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিত। বাবার পরিবারে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় বেড়ে উঠে স্বামীর সংসারেও জুটত সীমাহীন লাঞ্ছনা আর অমর্যাদায়। ছোটবেলা থেকেই এটাকে অন্যায় মনে হয়েছে আমার। আমি বুঝতে পারি মেয়েদের এই বঞ্চনার কবল থেকে বের করতে হলে প্রথমেই তাকে শিক্ষিত হতে হবে। উৎপাদনের হাল হবে। এ জন্য প্রথমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কন্যাশিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করি। বাবা-মায়েদের বোঝাই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে নিচু নয় কিংবা তারা বোঝাও নয়। সুযোগ পেলে তারা একটি পরিবারের নেতৃত্ব দিতে পারে। বোঝাই অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার অপকারিতা। নিজের তাগিদে গ্রামে ঘুরে যৌতুক নেওয়া-দেওয়া যে একটা সামাজিক অপরাধ, সে সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করি। প্রথমে আমাকে অনেকে পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। একবার-দুবার নয়, বারবার দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। মানুষ এখন এটাকে অনুধাবন করতে পেরেছে। এখন এই গ্রামের কোনো কন্যাশিশু বিদ্যালয়ের বাইরে নেই। অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা একেবারেই কমে গেছে। নারীরা খেতে-খামারে কাজ করছেন। আগের ছবির সঙ্গে এখনকার ছবি মেলাতে যাই কিন্তু মেলে না। নিজের মধ্যে অদম্য ইচ্ছা থাকলে দুঃসময়কে সুসময়ে পরিণত করা সম্ভব, সেই আত্মবিশ্বাস আমার এগিয়ে চলার পথকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
তবু অতৃপ্তি...
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে চারদিক যেমন ভুতুড়ে অন্ধকার নামিয়ে দেয়; একদিন এই রাখাইনপল্লি ও আশপাশের গ্রামগুলোর জীবনযাপন এমন অন্ধকারের নিগড়েই বাঁধা ছিল। এখন কিছুটা আলোর মুখোমুখি আমরা। কিন্তু এই আলোর প্রদীপকে জিইয়ে রাখতে হলে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। আমি খুব ছোট পরিসরে শুরু করেছি। এখনো অনেক কাজ বাকি। একার পক্ষে এত প্রতিকূলতা ছাপিয়ে এত বড় পরিবর্তন অসম্ভব। এ জন্য সবার ইতিবাচক মানসিকতা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, আমাদের জীবনটা খুব ছোট। তাই মানুষ নামের প্রাণী হিসেবে পৃথিবী ও এর সব প্রাণিকুলের প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব। আমরা তার কতটুকু পালন করি। যদি সবাই যে যার অবস্থান থেকে সাধ্যমতো কিছু করি তবে দুঃখ, কষ্ট, অশিক্ষা, অন্যায়, অশান্তি এবং দারিদ্র্য কোনো স্থায়ী সমস্যা হতে পারে না। যখন কোনো মানুষের প্রয়োজনে আমি অক্ষম হই, তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। তবু সাধ্যমতো চেষ্টা করছি কিন্তু যতটুকু করি তার চেয়ে অনেক বেশি অতৃপ্তি আমার। প্রতিদানের জন্য নয়, মানুষের প্রয়োজনে মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়াবে এটাই মানবজীবনের একমাত্র ব্রত হওয়া উচিত। এর চেয়ে বড় কোনো মহৎ কাজ আর কি থাকতে পারে?
খেন চেন: শিক্ষক, তালতলী ডিগ্রি কলেজ
অনুলিখন: এম জসীম উদ্দীন, বরগুনা প্রতিনিধি