ইতিহাস পুনরুদ্ধারের লড়াই

ছবি: সাহাদাত পারভেজ
ছবি: সাহাদাত পারভেজ

বাঙালি আন্দোলন করে, সাধারণত ব্যর্থ হয়, কখনো কখনো সফল হয়; 
এবং সফল হওয়ার পর মনে থাকে না কেন তারা আন্দোলন করেছিল।
—অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ
১.
আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হওয়ার পরও তাকে রক্ষায় কম চেষ্টা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র তখন যারা ‘সপ্তম নৌবহর’ পাঠিয়ে পাকিস্তানিদের পরাজয় ঠেকাতে চেয়েছিল, তারাও মরিয়া হয়ে উঠল কাদের মোল্লাকে রক্ষা করতে। আবার এদিকে সরকারি দলের এক সাংসদও বললেন, ‘এই কাদের মোল্লা কসাই কাদের মোল্লা নন’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে মুঠোফোনেও লাখ লাখ খুদে বার্তা পাঠিয়ে কাদের মোল্লার অনুসারীরা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগল ‘ইনি আসল কাদের মোল্লা নন’। কিন্তু কাদের মোল্লার আসল প্রভুরা অর্থাৎ পাকিস্তানের মন্ত্রী-সাংসদেরা যখন সে দেশের জাতীয় পরিষদে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের বিপরীতে নিন্দা প্রস্তাব পাস করেন তখন কি আর আসল-নকলের বিষয়ে কোনো সংশয় থাকে! বাঙালিদের স্মৃতিশক্তি ‘মন্দ’ হলেও পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট প্রখর বটে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের একজন একনিষ্ঠ অনুরাগীকে তারা ভুলে যায়নি!
২.
পাকিস্তান রাষ্ট্রের আবির্ভাবের পর বাঙালি জাতির প্রথম মাইলফলক অর্জিত হয় ১৯৫২ সালে। সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে বাঙালি পূর্ণ সজাগ আছে কি? বাবা-মায়ের সঙ্গে একুশে বইমেলায় আসা এক শিশুকে প্রশ্ন করা হলো, কী ঘটেছিল ২১ ফেব্রুয়ারি, কিন্তু শিশুটি বলতে পারল না। আবার প্রাপ্তবয়স্ক একজনকে প্রশ্ন করা হলে তিনিও ঠিক বলতে পারলেন না। বছর দুই আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদনে তুলে ধরা এ রকম একটি বিষয় নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। আমি নিশ্চিত ওই প্রতিবেদনটি দেখার পরে অনেকেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন জানার চেষ্টা করে থাকবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবছর সারা দেশে ২১ ফেব্রুয়ারিতে সব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়ার পরও কেন অনেকেই ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটুকুও জানেন না। প্রায় সব বাবা-মা চান সন্তান যেন ইংরেজিটা ভালো জানে। কিন্তু বাংলা শেখানোর বেলায় উদাসীন। চারদিকে নতুন নতুন কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এসবের অধিকাংশেরই নামকরণ হয় ইংরেজিতে আর কিছু আরবিতে। শিশুপাঠ্য আদর্শলিপি তো মনে হয় এখন জাদুঘরেই দেখতে হবে।

৩.
১৯৬২ সালে সংগঠিত হয়েছিল মহান শিক্ষা আন্দোলন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের আমলে গঠিত ‘শরিফ শিক্ষা কমিশন’-এর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল ‘শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়’। ব্যবসায় বিনিয়োগের মতো করে শিক্ষাব্যয়কে বিবেচনা করতে বলা হয়। ছাত্ররা সেদিন তা মানেনি। ‘৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রদের আহূত হরতালে শ্রমিক-জনতা হয়ে এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। মোস্তফা, বাবুল আর ওয়াজিউল্লাহর রক্তে শিক্ষার ন্যায্য অধিকার রক্ষায় সেদিন যে ইতিহাস নির্মিত হয়েছিল তার স্মরণেই আমরা ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস পালন করি। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীও ‘৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে ছিলেন বলে প্রায়ই দাবি করে থাকেন। বর্তমান সময়ে যে শিক্ষা আদতেই ব্যবসায়িক বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে তার জন্যও আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর যথেষ্ট ‘কৃতিত্ব’ দাবি করতে পারেন। পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণির একটি শিশুর পরীক্ষার আগের রাতে তার শিক্ষক ও অভিভাবক অর্থকড়ি নিয়ে খোঁজ লাগান প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো কি না! শিশু বয়েসেই যে শিক্ষার্থীটি নিজের অভিভাবক-শিক্ষকের সহায়তায় এমন উপায় বেছে নেবে ভবিষ্যতে কোনো আদর্শিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার মতো শক্তি তার মধ্যে অবশিষ্ট থাকবে কি?

৪.
মুক্তিযুদ্ধের পর পরই আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু হতে শুরু করে। যথারীতি পাবলিক পরীক্ষাগুলোও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সদ্যই সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশটির তরুণেরা কি সে সময় একাডেমিক পড়ালেখার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন? কিংবা দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই বা সে জন্য কতটুকু প্রস্তুত ছিল? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তরুণেরা পরীক্ষা দিতে বসলেন আর তাঁদের ‘যথাযথ প্রস্তুতি নেই’ এমন কারণে পরীক্ষায় নকল করাটা অলিখিত অনুমোদন লাভ করল। এই তরুণদের অধিকাংশই মাত্র কয় দিন আগে একটি মহান আদর্শিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই লড়াইয়ে তাঁরা বিজয়ীও হয়েছিলেন। কিন্তু সে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রটি তাঁরা পেলেন, সেখানে শুরুতেই একটি অনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবনে প্রত্যাবর্তন করতে হলো। স্বাধীন দেশে তরুণদের সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষয়ক্ষতি মেরামতের জন্য স্বেচ্ছাসেবায় নিয়োগ করা যেত। তাতে দেশ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতো আর তরুণেরাও একটি নেতিবাচক প্রবণতার মধ্যে নিমজ্জিত হতেন না।

৫.
বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে এক কাতারে লড়াই-সংগ্রাম করল, রাজপথে রক্ত দিল। কিন্তু স্বৈরাচারকে হটিয়ে এমন গণতন্ত্র এল যা ছাত্রদেরই গণতান্ত্রিক চর্চার অধিকার রুদ্ধ করে দিল। অথচ স্বৈরাচারের আমলেও ছাত্র সংসদ চালু ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নাম করে ঠিকই ফি আদায় হচ্ছে। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশের আওতাধীন প্রধান চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিত্ব থাকার বিধান থাকলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়ে আসছে ছাত্রদের কোনো মতামত ছাড়াই। অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সিনেট নেই। পাশাপাশি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নব্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সিনেট নেই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিচালনা পর্ষদ সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ডেই সীমাবদ্ধ যেখানে ছাত্র প্রতিনিধিত্বের কোনো বিধানই নেই।

৬.
সম্ভবত ১৯৯৩ সাল থেকে আমাদের দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটা তরুণ-তরুণীরা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে পালন করেন। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দিনটিকে ঘিরে তাদের বিভিন্ন পণ্য বা উপহারসামগ্রীর বিজ্ঞাপন দেয়। তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। বড় বড় কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন করা হয় কনসার্ট। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে এ দেশের তরুণদের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে।
এবং সেই ইতিহাসটি ভুলিয়ে দিতে এই ভালোবাসা দিবসের ‘অবদান’ অস্বীকার করার উপায় নেই! ১৯৮৩ সালের এই দিনটিতে স্বৈরাচার সরকারের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি করে। দীপালি, কাঞ্চন, জয়নালসহ যাঁরা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের রক্তের আবির ঢাকা পড়েছে ভালোবাসা দিবসের গোলাপের পাপড়িতে।

৭.
১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ‘গণ-আদালত’ গড়ে উঠেছিল। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সে আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদার সব রাজনৈতিক দল প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বেলায় কৃতিত্ব ও কর্তৃত্বের দাবিদার সবচেয়ে বৃহৎ দলটি ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুদ্ধাপরাধীদের দলের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য গঠন করল। আবার তারাই ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করে তরুণদের পক্ষ থেকে বিপুল সমর্থন লাভে সক্ষম হয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই সরকার বিচার শুরু করতে, বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে সময়ক্ষেপণ শুরু করল। যাহোক, অবশেষে বিচার শুরু হলো। সরকারের শেষ বছরে এসে যাও প্রথম রায়টি ঘোষণা হলো, কিন্তু সরকারের নাকের ডগা দিয়ে দেশের সীমানা অতিক্রম করে পালিয়ে গেল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাচ্চু রাজাকার। এরপর ৩৪৫ জন মানুষের খুনি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড! তারুণ্যের গণজাগরণে সরকার বাধ্য হলো রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের বিধান যুক্ত করে আইন সংশোধন করতে। এ আন্দোলনে প্রেরণা শহীদজননী! তরুণেরা জাহানারা ইমামকে ভোলেনি। পাশাপাশি তরুণেরা ফিরিয়ে আনল মুক্তিযুদ্ধের সব স্লোগান। আবার কোনো কোনো স্লোগান নতুনভাবে উচ্চারিত হলো। ‘তুমি কে, আমি কে/ বাঙালি-বাঙালি’ স্লোগানটি শাহবাগে উচ্চারিত হলো ‘তুমি কে, আমি কে/ আদিবাসী-বাঙালি’। তরুণেরা ভুলে যায় নি উক্যচিং (ইউকে চিং) মারমা বীরবিক্রমের মতো আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা।

৮.
গণজাগরণের আন্দোলন শুরুর মাস খানেক পর আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণার উদ্দেশ্যে একটি স্কুলে গিয়েছিলাম। শিশুদের বোঝালাম কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। আন্দোলনের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসে ঢুকলাম। আমরা কেন গিয়েছি তা শুনেই তারা বেশ উৎফুল্ল হলো। ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে আমি বলতে শুরু করলাম। কিন্তু দেখলাম শিক্ষার্থীরা আমাকে থামিয়ে দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেরাই বলে যাচ্ছে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের কুকীতির্র নানা বিবরণ। বড়দের মতো করে না হোক তারা তাদের মতো করেই বলে যাচ্ছিল। কেউ একজন বলতে গেলে আরেকজন তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে বাকিটুকু বলতে চাইছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের নাম বলতে গিয়ে আমি যে দু-একটি নাম বলিনি তারা সেগুলোও আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। বিদায় নেওয়ার আগে আমি প্রশ্ন করেছিলাম তারা আমার পরিচয় জানে কিনা। উত্তরে তারা বলল, ‘আপনি হচ্ছেন জয় বাংলা’।

আমরা কেন আন্দোলন করেছিলাম তা যদি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে না যায়, তবেই আমাদের সংগ্রাম স্থায়ী হবে। তবে এই সংগ্রাম বলবৎ থাকলে যাদের আঁতে ঘা লাগার সম্ভাবনা আছে তারা নিশ্চয়ই বসে নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রত্যক্ষ বিরোধী অংশ এবং যারা এ চেতনা রক্ষার কথা বলে আদতে নিজেদের যাবতীয় অপকর্ম হালাল করতে চায় উভয়েই আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই পূর্বসূরিদের লড়াই-সংগ্রামের যাবতীয় বিস্মৃত ইতিহাস পুনরুদ্ধারে তরুণদের এখনো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
লাকী আক্তার: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।