কক্সবাজার থেকে জাতীয় দলে

ছবি: শামসুল হক
ছবি: শামসুল হক

আমাকে বলা হয়েছে খেলাধুলায় শুরু ও সাফল্যের গল্প লিখতে। সাফল্য? আমি মোটেও মনে করি না সাফল্য কিছু পেয়েছি। অর্জনও করতে পারিনি তেমন কিছু। ক্যারিয়ার তো সবে শুরু! তবে লোকের আগ্রহ যেমন আছে আমাকে নিয়ে, বড় কিছু প্রত্যাশা করে আমার কাছে, এসবে মনে হয় কিছু একটা হয়তো করেছি। যদিও আমি এটিকে ‘সাফল্য’ মনে করি না। আমি বলতে পারি আমার শুরু নিয়ে।
পেছন ফিরে তাকালে একটা ছবি প্রায়ই চোখে ভাসে আমার। কক্সবাজার জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি বন্ধু আরিফের সঙ্গে। ১৩ কি ১৪ হবে তখন আমার বয়স। বিকেএসপির ক্যাম্প চলছিল মাঠে। সেদিকে অপলক তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, ‘যদি আমিও থাকতে পারতাম ক্যাম্পে!’
কক্সবাজারে আমরা থাকি বৈদ্যরকোনায়। কিন্তু খেলতাম পাশেই বৈল্যরপাড়া সিঅ্যান্ডবি কলোনি মাঠে। টেপ টেনিসের বল দিয়ে খেলতাম আমরা। কিন্তু তখন থেকেই আমি সোজা ব্যাটে, বেসিক মেনে খেলতাম। এটা সহজাতভাবেই ছিল আমার মধ্যে। উল্টাপাল্টা শট খেলতাম না। বড় ভাইয়েরা আমার ব্যাটিং দেখতে আসতেন। একটা লফটেড শট খেললেই সবাই চেঁচাতেন, ‘তোর এভাবে খেলার দরকার নাই। তুই সোজা ব্যাটে খেললে দেখতে ভালো লাগে।’ আমার নিজের বড় ভাই, শাওন ভাই, এলাকার বড় ভাইয়েরা সব সময় এটা বলতেন। ব্যাপারটি তখনই আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল।
কলোনির মাঠে খেলা, প্রায়ই বল গিয়ে আশপাশে বাসার জানালা ভাঙত। অনেকের গায়ে লাগত। লোকজনের অভিযোগের শেষ ছিল না। একবার অতিষ্ঠ হয়ে কয়েকজন জোট বেঁধে পুলিশ ডেকে আনল। আমরা তো হতভম্ব। ফরহাদ ভাইকে দেখিয়ে তারা বলল, ‘এইটা হলো নাটের গুরু, কোচ। এইটারে ধরেন।’ ফরহাদ ভাইকেসহ আমাদের ব্যাট-স্টাম্প নিয়ে গেল পুলিশ। স্রেফ ভয় দেখানোর জন্য, একটু পরেই ছেড়ে দিয়েছে। ভয় আমরা পেয়েছিলাম খানিকটা, তবে দমে যাইনি। পরদিন থেকেই প্রবল উৎসাহে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম!
আমাদের পাড়ায় পাড়ায় ম্যাচগুলো তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো। অন্য পাড়ার সঙ্গে ম্যাচের আগে নিজেদের মধ্যে দুই-তিনটি ম্যাচ হতো। সেটার পারফরম্যান্সে আমাদের দল ঠিক করা হতো। এখন মনে হয়, চাপে ভালো করা ব্যাপারটি তখন থেকেই ঢুকে গিয়েছিল আমার মধ্যে। সিরিয়াসলি ক্রিকেট খেলা বা জাতীয় দলে খেলার কথা তখনো ভাবনাতেই ছিল না। ভাবনা এল, ওই বিকেএসপির ক্যাম্পটা দেখে। জেলা স্টেডিয়ামে ক্যাম্প দেখতে গিয়ে মনে হলো, আমিও চেষ্টা করতে পারি! শুনলাম পরের বছর আবার হবে ক্যাম্প। অপেক্ষায় রইলাম।
বছর ঘুরে আবার ক্যাম্পের সময় এল। পরীক্ষা দিলাম। দেখি যারা চার-ছয় মারার চেষ্টা করছে, তারা বাদ। আমি তো এমনিতেই সোজা ব্যাটে নিচে নিচে খেলি। একটু দেখেই আমাকে নিয়ে নিল এক মাসের ক্যাম্পে। ওই ক্যাম্পেও ভালো করলাম। তখন বিকেএসপি কোচ নাজিম স্যার আমাকে বললেন বিকেএসপিতে পরীক্ষা দিতে। বাসায় বললাম, কেউ রাজি নন। প্রথমে শাওন ভাইয়াকে রাজি করালাম। পরে আমার কোচ বাবাকে রাজি করালেন। বাবা করালেন মাকে। বাবা-মা আমাকে নিয়ে চললেন বিকেএসপিতে পরীক্ষা দিতে। আম্মার সে কী টেনশন! তাঁর টেনশন দেখে আমি ফরম পূরণ করতে ভুল করে ফেলি। তিনিই আবার দিলেন বকা! যাহোক, সেসব শেষ হলো। কিন্তু পরীক্ষার আগেই আমি বাদ!
তখন ন্যূনতম উচ্চতা লাগত ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি। আমার ছিল ৪ ফুট ৭। অনেক অনুরোধে কাজ হলো না। আমরা তিনজনই মন খারাপ করে বাড়ির পথ ধরলাম। আব্বা বললেন, ‘সমস্যা নেই, পরের বছর আবার পরীক্ষা দিবি।’ তখন একটা ধারণা ছিল যে সাইকেল চালালেই লম্বা হওয়া যায়। কক্সবাজারে ফেরার পথেই চট্টগ্রাম থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকায় একটা সাইকেল কিনে দিলেন আব্বা। বাড়ি ফিরেই শুরু হলো সাইকেল চালানো। পরের বছর পরীক্ষা দিতে গেলাম যখন, উচ্চতা তখন ৫ ফুট। অনায়াসেই চান্স পেলাম বিকেএসপিতে।
সত্যি বলতে, বিকেএসপিতে আমি খুব একটা ভালো ছিলাম না। আমাদের ব্যাচে ছিলেন নাসির হোসেন। প্রথম দু-এক দিন দেখার পরই আমরা জানতাম নাসির জাতীয় দলে খেলবেন। কিন্তু আমার তেমন সম্ভাবনা ছিল না। তবে ভালো ক্রিকেটার না হলেও ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলাম। খুব ডিসিপ্লিনড, সবকিছু মেনে চলতাম। আমার মনে হতো, কোথাও সামান্য ফাঁকি দিলেও আমি হয়তো জাতীয় দলে খেলতে পারব না!
বিকেএসপি ছাড়ার সময় আমি স্পিনটা ভালোই খেলতাম। কিন্তু পেস বলে দুর্বল ছিলাম। কাট ছাড়া পেসে কোনো শট খেলতে পারতাম না। আমার মূল উন্নতিটা হয় বিসিবির একাডেমিতে এসে। একাডেমির ক্যাম্পে তখন ইমরান, সালাউদ্দিন, জুয়েল স্যাররা সুনির্দিষ্ট করে সবার দুর্বলতা চিহ্নিত করেছিলেন এবং সেটা নিয়ে কাজ করেছিলেন। অনেক উন্নতি হয় তখন আমার। পরের বছর আবার একাডেমির ক্যাম্প, তখন একাডেমির কোচ অস্ট্রেলিয়ার রস টার্নার। রসও খুব ভালো কাজ করেছিলেন।
ইমরান স্যার ও রস টার্নারের দুটি ক্যাম্পই খুব কাজে দিয়েছিল। ওই দুটি ক্যাম্প থেকেই আজ জাতীয় দলের অনেক তরুণ ক্রিকেটার এসেছেন—আমি, নাসির, বিজয়, সাব্বির, মুক্তার, মিঠুন...।
রস টার্নারের ক্যাম্পটি ছিল অনেক কঠিন। শুরুতে ছিল ফিটনেস ক্যাম্প। সকালজুড়ে ছিল কঠোর ফিটনেস ট্রেনিং, এরপর এক ঘণ্টার থিওরি ক্লাস। ফিটনেস ট্রেনিংয়ের এক মাস ব্যাটিং-বোলিং নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সবাই যখন বিশ্রাম নিত, আমি অল্প একটু বিশ্রাম নিয়েই দুপুরে লুকিয়ে লুকিয়ে পেছন দিয়ে চলে যেতাম ইনডোরে, ব্যাটিং করতে। তত দিনে আমার টনক নড়ে গেছে, বুঝে গেছি অনেক পেছনে আছি। বাড়তি খাটুনির বিকল্প নেই। সাকিব, তামিম ভাইদের সঙ্গে কথা বলতাম সুযোগ পেলেই। তাঁরা বলতেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আরও অনেক অনেক কঠিন।’ শুনে আমি আরও বেশি পরিশ্রম করতাম। অনেকেই হাসাহাসি করত আমার খাটাখাটনি নিয়ে, টিপ্পনী কাটত। মন খারাপ হতো, তবে জানতাম, ভালো করলে তারাই আবার বলবে যে এত খেটেছে বলেই উন্নতি হয়েছে। এখন তারা ঠিকই বলে যে ‘মুমিনুল সারা দিন ব্যাটিং করত, উন্নতি তো হবেই!’
সালাউদ্দিন স্যার সব সময়ই আমাকে বলতেন, পুল ভালো খেলতে না পারলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার দরকার নেই। জাতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে কথা বলে শুনতাম যে সব দলই আমাদের বিপক্ষে শর্ট বল করে বেশি। আমি তাই পুল নিয়ে কাজ করলাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মনে আছে, একপর্যায়ে তিন মাস আমি শুধু পুল শটই খেলেছি! সালাউদ্দিন স্যারের অবদান এখানে না বললেই নয়। বিকেএসপি থেকে শুরু করে একাডেমি হয়ে এখনো স্যার অনেক সাহায্য করেন।
যাহোক, আমি পরিশ্রম করে যাচ্ছিলাম। রস টার্নার বলতেন, ‘ইনডোরে মুমিনুল তো সারা দিন ব্যাটিং করে।’ আমি উন্নতিটা বুঝতে পারলাম যখন দক্ষিণ আফ্রিকা একাডেমি দল এল এখানে। বেশ কজন বোলার ছিল তাদের, যারা ১৪০ কিমি. গতিতে বোলিং করত। ভালোই করলাম তাদের বিপক্ষে। আমি আর বিজয় (এনামুল হক) তখন পাল্লা দিয়ে রান করত চাইতাম। বিজয় যখন ফিফটি করে ব্যাট তুলল, আমি গিয়ে বললাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা ২৫! সেঞ্চুরি করতে হলে তাই ২০০ করতে হবে। বিজয় ১৭০ করে আউট হলো। আমি বললাম, ৮৫ করেছ!’ আমরা আবার একাডেমি দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলাম। সেখানে আমি ১০০ ও ৮০ করলাম। বিজয় তখন বলল, আসলে সেঞ্চুরি হয়নি। আমরা ওভাবেই ভাবতাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই ছিল আমাদের মাথায়। ওই দুটি সিরিজে বুঝলাম আমার উন্নতি কিছু হয়েছে। এরপর সাকিব ভাইয়ের চোটে ২০১২ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। পরের গল্পটা সবারই জানা।
সাফল্যের পথে কেবল হাঁটা শুরু হয়েছে বলতে পারি। কছু রান পেয়েছি বলেই হয়তো এত আগ্রহ, এত প্রত্যাশা। যেমন আমি টেস্টে ফিফটি করলে কেউ খেয়ালও করে না, সেঞ্চুরি চায় সবাই। এটা একটা চাপ, তবে একদিক থেকে ভালোও আমার জন্য। জানি বড় কিছু করতে হবে। আমি সেঞ্চুরি করেও ব্যাট তুলতে চাই না, হেলমেট খুলতে চাই না। ভেতর থেকে আসে না, মনে হয় এতে আত্মতৃপ্তি চলে আসতে পারে। ভালো কিছুর তো শেষ নেই! সব ঠিক থাকলে অন্তত ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত খেলতে চাই। ক্যারিয়ার শেষে যদি দেখি টেস্ট গড় ৫০ থেকে ৬০, ওয়ানডে গড় ৪০-এর ওপর, হয়তো নিজেকে কিছুটা সফল বলতে পারি।
দেশের হয়ে খেলা, ভালো কিছু করার তাগিদটাই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমার আরেকটা বড় অনুপ্রেরণা আমার মা। মা এখন অসুস্থ হয়ে বিছানায়। কিছু করতে পারেন না, তবে সব অনুভব করতে পারেন। আমি রান করলে খুব ভালো থাকেন, চেহারায় খুশির আভা থাকে। রান না করলে মন খারাপ থাকে তাঁর। মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সব সময় রান করতে ইচ্ছা হয়। আমি ব্যাটিংয়ে নামলে বাবা বাড়িময় অস্থির পায়চারী করেন, টিভি দেখতে ভয় পান। এর-ওর কাছে জিজ্ঞেস করেন আমার রান। ছোট বোন ফোন করে বলে, ‘ভাইয়া, সাঙ্গাকারার মতো ধীরেসুস্থে ব্যাট করতে পারো না, তাড়াহুড়ো কেন করো!’ মজা লাগে। আমি বাড়ি ফিরলে অসুস্থ শরীরেও মা বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে যে হাসিটা দেন, মনে হয় ওই হাসিটা দেখার জন্য দুনিয়ার সবকিছু জয় করতে পারি। আমার পরিবার, আমার দেশ আমার অনুপ্রেরণা।
মুমিনুল হক: ক্রিকেটার, জাতীয় ক্রিকেট দল।